ডিজিটাল যুগে কুরআনিক নৈতিকতা
লিখকঃ- মাহাতাব আকন্দ
বন্ধুগণ,
ডিজিটাল পৃথিবী আজ শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে,
একটা লাইক মানে যেন ভালোবাসা,
একটা কমেন্ট মানে যেন সম্মান,
আর একটা শেয়ার মানে যেন সত্যের বিজয়।
কিন্তু এই পৃথিবীতে সত্য আর মিথ্যার সীমারেখা—
অনেকটা কাঁটাতারের মতো,
একটু অসতর্ক হলেই
মনের গায়ে রক্ত ঝরে।
কুরআন বলে—
“وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ”
অর্থাৎ— যা জান না, তার পেছনে দৌড়িও না।
আজ আমরা ঠিক তার উল্টোটা করি।
আমরা যাচাই করি না;
শেয়ার করি। চোখ দিয়ে পড়ি না;
শিরোনামেই বিচার করে ফেলি।
বন্ধুগণ,
ডিজিটাল স্ক্রিনের আলো মানুষের চোখে ঝলক দিলেও,
মনের অন্ধকারকে দূর করতে পারে না।
যখন কেউ মিথ্যা গুজব ছড়ায়—
একটা ফোনের স্পর্শে,
একটা লাইক আর শেয়ারের তাড়ায়
অন্য মানুষের সম্মান ধ্বংস হয়ে যায়।
আল্লাহ সতর্ক করেছেন—
“إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ… كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا”
তোমার শ্রবন শক্তির, তোমার দর্শনশক্তীর, তোমার মনের – সবকিছুর হিসাব হবে।
এই অনলাইন দুনিয়ায়,
আমাদের আঙুল হলো কলম,
আমাদের ক্লিক হলো সাক্ষ্য।
এখানেই আমাদের বিচার রয়ে গেছে।
বন্ধুগণ,
ফেক প্রোফাইল—
এই যুগের নতুন মুখোশ।
আগে মানুষ মুখ লুকোতে মুখোশ পরত,
এখন মানুষ চরিত্র লুকোতে পরছে
ডিজিটাল নাম, ডিজিটাল ছবি,
ডিজিটাল পরিচয়।
কুরআন বলে—
“قُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا”
– সোজা কথা বলো, সত্য কথা বলো।
কিন্তু আমরা কেমন?
একজন বাস্তবে ভদ্র, অনলাইনে বিষাক্ত।
বাস্তবে শান্ত, অনলাইনে যুদ্ধবাজ।
বাস্তবে চুপচাপ, অনলাইনে সিংহ।
যে মানুষ আসলে তুমি নও,
সে মানুষ হয়ে থাকার নামই—
ফেক প্রোফাইল।
বন্ধুগণ,
আমাদের অনলাইন ব্যবসা এমনই এক ময়দান,
যেখানে সততা হারালে,
আয় রোজগার থেকে বরকত হারিয়ে যায়।
কুরআন বলে—
“وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِينَ”
ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়।
আজকের যুগে “মাপে কম দেওয়া”
শুধু চাল-ডালের ওজন কমানো নয়—
এটা হলো:
ভুল বিজ্ঞাপন, ভুয়া রিভিউ,
প্রতারণামূলক অফার,
গ্রাহকের সাথে অসৎ ব্যবহার,
পণ্যের দোষ-গুণ লুকানো।
এই সবই মাপে কম দেওয়া,
এই সবই পাপ।
বন্ধুগণ,
ডিজিটাল যুগে প্রাইভেসি হলো ইজ্জত।
কুরআন বলে—
“وَلَا تَجَسَّسُوا”
গোপনে দোষ আবিষ্কারের চেষ্টা করো না, দোষ খোঁজাখুঁজি করো না।
আজ আমরা কী করি?
অন্যের প্রোফাইল দেখি,
অন্যের ছবি দেখি,
অন্যের ইনবক্সে ঢোকার চেষ্টা করি।
যার ব্যাপারে আমাদের কোনো অধিকার নেই—
সেই ব্যাপারে নাক গলাই।
একজনের প্রাইভেসি ভাঙা মানে হলো,
তার ঘরে ঢুকে চুরি করা।
আর ইজ্জতের চুরি— সবচেয়ে ভয়াবহ চুরি।
বন্ধুগণ,
সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—
এটা আমাদের অহং বাড়ায়।
আল্লাহ বারবার বলেন—
“لَا تُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ”
আল্লাহ দম্ভকারীকে পছন্দ করেন না।
একটা ছবি পোস্ট করি—
পোষ্টের দিকে চেয়ে থাকি,
কতজন লাইক দিল?
কতজন কমেন্ট করল?
অন্যের খুশি, দুঃখ, বিপদ বা অর্জন—
সবই হয়ে গেছে আজ প্রতিযোগিতা।
আমরা আজ লাইক দিয়ে
পরিমাপ করছি সম্মানকে।
বন্ধুগণ,
গেমিং করায় — দোষের কিছু নেই।
কিন্তু যখন গেম তোমার ঘুম চুরি করে,
তোমার সালাত চুরি করে,
পড়াশোনা চুরি করে,
তখন সেটা আর খেলা থাকে না—
এটা হয়ে যায় নেশা।
কুরআন বলে—
“وَلَا تُسْرِفُوا”
অপচয় কোরো না।
সময়ও একটি রিজিক।
এটা নষ্ট করা— নিজের জীবন অপচয় করা।
গেমিং তখন হারাম হয়—
যখন তুমি নিজে গেমিংয়ে হারিয়ে যাও।
বন্ধুগণ,
ফেসবুকে স্ট্যাটাস— টিকটকে ভিডিও—
ইউটিউবে কমেন্ট—
কোথাও যেন আমাদের ঈমান না হারিয়ে যায়।
কুরআন বলে—
“مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ”
তোমার মুখের প্রতিটি শব্দ নথিবদ্ধ হচ্ছে।
এখন সেই শব্দ মুখে নয়— পোস্টে।
কীবোর্ডে। কমেন্টে।
এবং সবই হিসাবের মধ্যে।
অনলাইনে যে কথাটা লিখলে
বাস্তবে বলতে লজ্জা পেতে—
সে কথাকে আল্লাহর কাছে গোপন মনে কোরো না।
বন্ধুগণ,
জাল খবর— এই যুগের নতুন আগুন।
এটা মানুষ মারছে, সম্পর্ক ভাঙছে,
সমাজকে বিষাক্ত করছে।
কুরআন শেখায়—
“فَتَبَيَّنُوا”
যাচাই করো।
যে খবর যাচাই ছাড়া ছড়ায়,
সে আগুন লাগায়।
অনলাইনে একজনের সম্মান নষ্ট করা—
বাস্তবে তার মুখে চড় মারার থেকেও বড় অপরাধ।
বন্ধুগণ,
আমরা আজ অন্যকে ছোট দেখানোর জন্য
দুর্বলদের নিয়ে মজা করি, ট্রোল করি,
বোকা বানাই।
কিন্তু কুরআন বলে—
“وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ”
একজন আরেকজনকে বিদ্রূপ কোরো না।
তুমি যাকে নিয়ে মজা করো—
সেও আল্লাহর সৃষ্টি। সেও সম্মানের যোগ্য।
তাকে আঘাত মানে—
তোমার আখিরাতকে আঘাত।
বন্ধুগণ,
কেউ কেউ এমনভাবে অনলাইনে শির্ক, কুফরি, বিদআত ছড়ায়—
মনে হয় এরা ঈমানের পাহারাদার!
গ্রামের মহিলারা যেমন দলবেধে বিয়ে বাড়িতে গীত গায়!
ঠিক তেমনি
একটা ভিডিও দেখলেই
দল বেঁধে কমেন্টে গালিগালাজ করে।
একটা পোস্ট দেখলেই
মানুষকে কাফির-ফাসিক বানিয়ে ফেলে।
কিন্তু কুরআন বলে—
“وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا”
মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলো।
দয়া ছাড়া দাওয়াত নেই,
কঠোরতা দিয়ে পরিবর্তন আসে না।
বন্ধুগণ,
ডিজিটাল যুগে সবচেয়ে বড় পাপ হলো—
রিয়া (লোক দেখানো সৎকর্ম)।
নামাজ পড়ে, কিন্তু সেলফি দেয় ফেসবুকে।
দান করে, কিন্তু রসিদ আপলোড করে।
ভালো কাজ করে, তবে দর্শক চায়, ভিউজ চায়।
কুরআন বলে—
“يُرَاءُونَ النَّاسَ”
তারা লোক দেখানোর জন্য কাজ করে…
এটাই সেই ডিজিটাল রিয়া—
যা নীরবে ঈমান খেয়ে ফেলে।
বন্ধুগণ,
সাইবার অপরাধ—
ব্ল্যাকমেইল, অশ্লীলতা,
হ্যাকিং, ইনবক্সে হয়রানি—
সবই বড় গুনাহ।
কুরআন বলে—
“لَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ”
অশ্লীলতার কাছেও যেয়ো না।
ডিজিটাল অশ্লীলতা—
বাস্তব অশ্লীলতা থেকেও ভয়াবহ,
কারণ এটা ছড়ায় সীমাহীন গতিতে।
বন্ধুগণ,
এই যুগে একটা দৃশ্য আছে—
মানুষ নিজের দুঃখ, কান্না, ভাঙা সম্পর্ক—
সবই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছুড়ে দেয়।
দুনিয়াকে সাক্ষী বানায় নিজে হোচট খেয়ে ব্যথা পেলেও,
কিন্তু আল্লাহকে ডাকতে লজ্জা পায়।
কুরআন বলে—
“وَلِلَّهِ عِزَّةُ الْأَمْرِ”
সম্মান আল্লাহর হাতে।
তোমার সম্মান দুনিয়ার হাতে দিয়ো না।
স্ক্রিনকে তোমার কান্নার সাথী বানিয়ো না।
তুমি ডেকো তাঁকে—
যার কাছে সবকিছুর সমাধান।
বন্ধুগণ,
অ্যালগরিদমের দুনিয়ায়
সত্য হারিয়ে যায়, ভিউ বাড়ে মিথ্যার,
ভাইরাল হয় অশ্লীলতা,
আর নিভে যায় নৈতিকতার আলো।
কিন্তু কুরআন কঠিন ভাষায় বলে—
“جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ”
সত্য এসেছে— মিথ্যা ধ্বংস হবেই।
একজন সত্যবাদী মানুষ
হাজার ডিজিটাল ভণ্ডের চেয়েও শক্তিশালী।
বন্ধুগণ,
আমরা সব শিখেছি—
স্ক্রল করা, স্মাইলি পাঠানো,
ভিডিও বানানো— কিন্তু শিখিনি
“তাকওয়া” নামের সেই সফটওয়্যারটা
যা হৃদয়ে ইন্সটল না থাকলে
সবই অর্থহীন।
তাকওয়াসম্পন্ন হৃদয়— ফেক নয়,
টক্সিক নয়, মিথ্যুক নয়।
এটা আল্লাহর ভয় এবং সততার ওপর দাঁড়ানো।
বন্ধুগণ,
শেষে একটা কথাই বলবো—
ডিজিটাল যুগ বদলাবে না,
অ্যালগরিদম বদলাবে না,
বদলাতে হবে তোমাকে!
সোশ্যাল মিডিয়া নষ্ট হলেও
তুমি নষ্ট হতে বাধ্য নও।
কুরআন বলে—
“إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ”
আমরা মানুষকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি।
পথ তুমি বেছে নেবে।
স্ক্রিন তোমার হাতেই,
কিন্তু তুমি থাকো কুরআনের তত্ত্বাবধানে—
তাহলে প্রতিটি ক্লিক হবে সওয়াব,
প্রতিটি মন্তব্য হবে দয়া,
প্রতিটি পোস্ট হবে আলো।
বন্ধুগণ,
ডিজিটাল দুনিয়ায় ঈমান ধরে রাখাটা—
একটি শান্ত নদীতে নয়,
তীব্র স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার মতো।
কিন্তু যে সাঁতার কেটে টিকে থাকে—
সেই মানুষই সফল।
কুরআন বলে—
“وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ”
শেষ পরিণাম তাকওয়াবানদের জন্য।


0 Comments