আজ আমরা আরো এমন এক গভীর প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়েছি, যা ইসলামের ইতিহাসের প্রথম পরীক্ষার সাথে জড়িত —
“আল্লাহ যখন ফেরেশতাদের আদমকে সিজদা করতে বললেন, তখন শয়তান অমান্য করল। তাহলে কি শয়তানও ফেরেশতা ছিল?”
এই প্রশ্নটি শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং তাওহীদের মূল দর্শনের পরীক্ষা। কারণ এখানে লুকিয়ে আছে অহংকার, আনুগত্য ও আল্লাহর জ্ঞানের রহস্য।
বন্ধুগণ!
চলুন প্রথমে কুরআনের আয়াতটি দেখি —
"وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ كَانَ مِنَ الْجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ أَمْرِ رَبِّهِ"
অর্থাৎ — “আমি যখন ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা করো — তারা সবাই সিজদা করল, শুধু ইবলিস ছাড়া। সে ছিল জিনদের মধ্য থেকে; তাই সে তার প্রভুর আদেশ অমান্য করল।” (কাহফ ১৮ঃ৫০)
বন্ধুগণ!
এই আয়াতেই সব উত্তরের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে।
আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করলেন — “কানা মিনাল জিন্নি” — সে ছিল জিনদের অন্তর্ভুক্ত!
অতএব, ইবলিস কোনো ফেরেশতা ছিল না, বরং “জিন” জাতির একজন সদস্য।
তাহলে প্রশ্ন আসে —
যদি সে ফেরেশতা না হয়, তাহলে কেন তাকে ফেরেশতাদের সঙ্গে সিজদার আদেশ দেওয়া হয়েছিল?
বন্ধুগণ!
আল্লাহর বিধান সর্বদা জ্ঞানে পরিপূর্ণ।
শয়তান ফেরেশতা না হলেও, সে দীর্ঘ সময় ধরে ফেরেশতাদের সান্নিধ্যে অবস্থান করেছিল।
সে ছিল অতীব ইবাদতকারী, দীর্ঘকাল আল্লাহর আনুগত্যে নিবেদিত এক সৃষ্ট।
তার ইবাদত ও জ্ঞানের উচ্চতার কারণে তাকে ফেরেশতাদের মাঝে সম্মানজনক স্থানে স্থান দেওয়া হয়েছিল।
এমনকি সে ফেরেশতাদের সঙ্গে আল্লাহর প্রশংসা করত, আল্লাহর আদেশ পালন করত।
তবে তার অন্তরে লুকিয়ে ছিল একটি গোপন ব্যাধি — অহংকার।
বন্ধুগণ!
এখন একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক — ফেরেশতা, জিন ও মানুষ — এই তিনটি সৃষ্টিই আলাদা প্রকৃতির।
কুরআনে আল্লাহ বলেন —
"خَلَقَ الْإِنسَانَ مِن صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ، وَخَلَقَ الْجَانَّ مِن مَّارِجٍ مِّن نَّارٍ"
(সূরা রহমান ৫৫:১৪-১৫)
অর্থাৎ — “মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে পোড়ামাটির মতো শুকনো কাদামাটি থেকে, আর জিনকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুনের শিখা থেকে।”
আর ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয়েছে নূর (আলো) থেকে,
যেমন রাসূল ﷺ বলেছেন —
“خُلِقَتِ الْمَلَائِكَةُ مِنْ نُورٍ”
(সহিহ মুসলিম)
অতএব, ফেরেশতা, জিন ও মানুষ — তিনটি আলাদা জাতি।
ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না, জিনদের মধ্যে আছে ভালো-মন্দ উভয় প্রকার, আর মানুষ হচ্ছে পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি এক স্বাধীন জাতি।
বন্ধুগণ!
তাহলে যখন আল্লাহ ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন — “আদমকে সিজদা করো”,
তখন সেই আদেশের আওতায় উপস্থিত সব সৃষ্টিই অন্তর্ভুক্ত হলো যারা ফেরেশতাদের মাঝে ছিল —
শয়তানও তাদের একজন ছিল উপস্থিতির দিক থেকে।
তাই আদেশ তার উপরও প্রযোজ্য হলো।
কিন্তু সে অমান্য করল।
সে বলল —
"أَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِن طِينٍ"
অর্থাৎ — “আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে, আর তাকে মাটি থেকে।” (সুরা আরাফ ৭ঃ১২)
এই এক বাক্যই ছিল তার পতনের সূচনা।
বন্ধুগণ!
এখানে শয়তান কেবল আদেশ অমান্য করেনি, বরং আল্লাহর সিদ্ধান্তের জ্ঞানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সে মনে করেছিল — আগুনের প্রকৃতি মাটির চেয়ে উচ্চ।
কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল, শ্রেষ্ঠত্ব বস্তুতে নয় — বরং আল্লাহর আদেশ মানায়।
আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ সেই, যে বিনয়ী ও আনুগত্যশীল।
কুরআনে আল্লাহ বলেন —
"أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ"
অর্থাৎ — “সে অস্বীকার করল, অহংকার করল, এবং অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হলো।” (সুরা বাকারা ২ঃ৩৪)
বন্ধুগণ!
এখন একটু চিন্তা করো — ফেরেশতারা তো কখনো অবাধ্য হয় না।
কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে —
"لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ"
অর্থাৎ — “তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না; যা আদেশ পান, তা-ই করে।” ( সুরা তাহরীম ৬)
তাহলে যে অবাধ্যতা করল, সে ফেরেশতা কিভাবে হতে পারে?
এই যুক্তিই প্রমাণ করে, শয়তান ফেরেশতা নয়।
সে ছিল “জিন”, যার মধ্যে ছিল “ইচ্ছার স্বাধীনতা” — মানে চাইলেই মানতে পারে, না চাইলে অমান্য করতে পারে।
আর সেই স্বাধীনতাই তার পতনের কারণ হলো।
বন্ধুগণ!
এই ঘটনাটি আসলে কেবল এক ঐতিহাসিক গল্প নয় — এটি পুরো মানবজাতির শিক্ষা।
শয়তানের কাহিনি আমাদের শেখায়, অহংকারই সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা।
সে নামাজ পড়ত, ইবাদত করত, ফেরেশতাদের মাঝে বাস করত —
কিন্তু এক মুহূর্তের অহংকার সবকিছু ধ্বংস করে দিল।
এবং সেই অহংকার আজও মানুষকে ধ্বংস করছে।
যে মানুষ নিজের জাত, বংশ, গোষ্ঠী, জ্ঞান বা সম্পদের কারণে নিজেকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবে —
সে-ই আসলে শয়তানের পথ অনুসরণ করছে।
কারণ শয়তানও বলেছিল — “আমি ভালো, সে খারাপ।”
এই “আমি”ই হলো কুফরির বীজ।
বন্ধুগণ!
আরও একটি বিষয় খেয়াল করো —
যখন আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেন, আদমকে সিজদা করো,
সেটা কোনো উপাসনামূলক সিজদা ছিল না, বরং স্বীকৃতির সিজদা।
অর্থাৎ “আদমের জ্ঞান ও মর্যাদাকে মেনে নাও, তাকে সম্মান করো।”
কারণ আল্লাহ আদমকে জ্ঞান দিয়েছিলেন —
"وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا" (সূরা বাকারাহ ২:৩১)
অর্থাৎ — “আল্লাহ আদমকে সব কিছুর নাম ও জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন।”
তাই আদম ছিলেন জ্ঞানের প্রতীক, আল্লাহর প্রতিনিধি।
আর যে সেই সত্যকে অস্বীকার করল, সে আল্লাহকেই অস্বীকার করল।
বন্ধুগণ!
আজও সেই পরীক্ষা চলছে।
আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান, যুক্তি ও আত্মসমর্পণের ক্ষমতা দিয়েছেন।
যে বিনয়ী হয়ে সত্যকে গ্রহণ করবে, সে “ফেরেশতাসুলভ”;
আর যে অহংকারে সত্য অস্বীকার করবে, সে “শয়তানের পথিক।”
শয়তান নামাজে ছিল, কিন্তু আনুগত্যে ব্যর্থ হয়েছিল।
সে আল্লাহর অস্তিত্ব মানত, কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত মানেনি।
এই পার্থক্যটাই তাকে ধ্বংস করল।
বন্ধুগণ!
সুতরাং, সংক্ষেপে ও স্পষ্টভাবে —
শয়তান ফেরেশতা ছিল না; সে ছিল জিন জাতির একজন, যাকে আল্লাহ ইবাদতের মাধ্যমে উন্নত স্থানে তুলেছিলেন।
কিন্তু সে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবল, অহংকার করল, আল্লাহর হুকুম মানল না।
ফলে সে হয়ে গেল লাঞ্ছিত, অভিশপ্ত, প্রত্যাখ্যাত।
বন্ধুগণ!
এই কাহিনি আমাদের একটাই শিক্ষা দেয় —
আল্লাহ কাউকে তাঁর পদ, জাতি বা সৃষ্টি উপাদানের কারণে শ্রেষ্ঠ মনে করেন না।
বরং আল্লাহর দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ সেই —
"إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ"
(সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩)
অর্থাৎ — “তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই, যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু।”
অতএব অহংকার, জাতিগত গর্ব, জ্ঞান বা ক্ষমতার গৌরব —
সবই শয়তানের উত্তরাধিকার।
আর বিনয়, আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য —
এটাই ফেরেশতাদের পথ, এটাই আদমের পথ, এটাই ইসলামের মূল শিক্ষা।
বন্ধুগণ!
তাহলে স্পষ্ট হলো —
শয়তান কোনো ফেরেশতা নয়; সে জিন।
তবে তার গল্পটি আমাদের জন্য আয়না,
যেখানে আমরা নিজেদের অহংকার, অবাধ্যতা ও আত্মপ্রবঞ্চনা দেখতে পাই।
আল্লাহ চান আমরা যেন শয়তানের মতো না হই —
বরং আদমের মতো ভুল করলেও, তাওবা করি, বিনয়ী হই, আর আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করি।
এটাই প্রকৃত সিজদা —
মাটিতে নয়, অন্তরের গভীরে।

0 Comments