ইউসুফ পরিবারের সিজদা কেমন ছিলো?
বন্ধুগণ!
আজো আমি এক প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আপনাদের নিকট উপস্থিত হয়েছি, দারুন সুন্দর একটি প্রশ্ন। — ইউসুফ (আঃ)-এর পিতা-মাতা ও ভাইয়েরা কি সত্যিই তাঁকে সিজদা করেছিলেন?
এই প্রশ্নটি কেবল ইতিহাস নয়, বরং আল্লাহর দীন বোঝার গভীর একটি রহস্য। কারণ যদি আমরা “সিজদা” শব্দের প্রকৃত অর্থ না বুঝি, তবে আমরা কুরআনকেও ভুল বুঝবো। চলুন, আল্লাহর কিতাব থেকেই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝে নেই।বন্ধুগণ!
কুরআনে আল্লাহ বলেন —
"وَرَفَعَ أَبَوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ وَخَرُّوا لَهُ سُجَّدًا"
(সূরা ইউসুফ ১২:১০০)
অর্থাৎ — "তিনি (ইউসুফ) তাঁর পিতা-মাতাকে সিংহাসনের উপর বসালেন, এবং তারা সবাই তাঁর জন্য সিজদায় লুটিয়ে পড়ল।"
এখানে অনেকেই তাড়াহুড়ো করে বলেন — “দেখো! তারা তো ইউসুফকে সিজদা করেছিল।”
কিন্তু বন্ধুগণ, কুরআন কখনোই “মানবকে সিজদা করো” — এ আদেশ দেয়নি। বরং আল্লাহর স্পষ্ট বাণী —
"فَلَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ"
(সূরা ফুসসিলাত ৪১:৩৭)
অর্থাৎ — “সূর্য কিংবা চাঁদকে সিজদা করো না, বরং সিজদা করো সেই আল্লাহকে, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।”
তাহলে প্রশ্ন জাগে — ইউসুফ (আঃ)-এর সামনে তারা কেন সিজদা করলেন?
বন্ধুগণ!
এখানে আসল রহস্য লুকিয়ে আছে “সিজদা” শব্দের অর্থে।
“سجد” (সাজাদা) মূলত অর্থ বশ্যতা স্বীকার করা, আত্মসমর্পণ করা, মেনে নেওয়া, বা সম্মান প্রদর্শন করা।
অর্থাৎ শারীরিকভাবে মাটিতে মাথা ঠেকানোই সিজদা নয় — বরং যার আদেশ, সম্মান বা সত্যকে তুমি মেনে নাও, সেটিই সিজদা।
বন্ধুগণ!
যখন ফেরেশতাদের বলা হয়েছিল,
"اسْجُدُوا لِآدَمَ" — “আদমকে সিজদা করো”
(সূরা বাকারাহ ২:৩৪),
তখনও তা কোনো উপাসনামূলক সিজদা ছিল না। বরং অর্থ ছিল —
“আদমের শ্রেষ্ঠত্ব, জ্ঞানের মর্যাদা ও আল্লাহর নিদর্শনকে স্বীকার করো।”
কারণ ফেরেশতারা তো আল্লাহ ছাড়া কাউকেই ইবাদত করে না।
তারা কেবল আল্লাহর আদেশকে “মেনে নেয়” — এটিই তাদের সিজদা।
বন্ধুগণ!
তেমনি ইউসুফ (আঃ)-এর পিতা-মাতা ও ভাইয়েরাও তাঁকে সিজদা করেছিলেন অর্থাৎ তাঁকে মেনে নিয়েছিলেন,
তাঁর মর্যাদাকে স্বীকার করেছিলেন।
কারণ ইউসুফের সেই ছোটবেলার স্বপ্নে তিনি দেখেছিলেন —
"إِنِّي رَأَيْتُ أَحَدَ عَشَرَ كَوْكَبًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ رَأَيْتُهُمْ لِي سَاجِدِينَ"
(সূরা ইউসুফ ১২:৪)
অর্থাৎ — “আমি দেখেছি এগারোটি তারা, সূর্য ও চাঁদ — সবাই আমাকে সিজদা করছে।”
এই স্বপ্নের বাস্তব রূপ হলো — পরবর্তীতে তাঁর পরিবার তাঁর নেতৃত্ব, জ্ঞান ও সত্যের সামনে মাথা নত করেছিল —
মানে তাঁকে “মেনে নিয়েছিল”, তাঁর সত্যতার সামনে আত্মসমর্পণ করেছিল।
এটাই “সিজদা” শব্দের প্রকৃত অর্থ।
বন্ধুগণ!
তাদের সেই সিজদা ইউসুফের উদ্দেশ্যে ছিল না, বরং আল্লাহর নির্দেশ ও আল্লাহর পরিকল্পনার প্রতিই আত্মসমর্পণ ছিল।
তারা স্বীকার করেছিল যে ইউসুফই আল্লাহর নির্বাচিত দাস, যাকে আল্লাহ সত্য দিয়ে সম্মানিত করেছেন।
তাদের সিজদা আসলে ছিল ইউসুফের মাধ্যমে প্রকাশিত আল্লাহর হিকমাহ বা আল্লাহর প্রজ্ঞার সামনে বিনয় প্রকাশ।
বন্ধুগণ!
এখন যদি কেউ বলে — “না, তারা ইউসুফকেই সিজদা করেছিল”, তাহলে প্রশ্ন আসে —
কেন আল্লাহর রাসূল ইয়াকুব (আঃ), যিনি তাওহীদের দাঈ, তিনি তাঁর সন্তানদের নিয়ে ইউসুফকে সিজদা করবেন?
আল্লাহ তো কখনো শিরক মেনে নেন না!
তিনি স্পষ্ট বলেছেন —
"إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ"
(সূরা নিসা ৪:৪৮)
অর্থাৎ — “আল্লাহ কখনো শিরক ক্ষমা করবেন না।”
তাহলে কোনো নবীই এমন শিরকমূলক কাজ করতেন না।
অতএব তাদের সিজদা ছিল সম্মান ও মেনে নেওয়া।
বন্ধুগণ!
আজও তুমি যখন সত্যিকারের কোনো নেতাকে, জ্ঞানীকে বা অভিভাবককে সম্মান করো,
তুমি তাঁকে মাটিতে লুটিয়ে না পড়লেও, অন্তরে তাঁর আদেশকে মেনে নাও —
এটাই “সিজদা”র অন্তর্নিহিত ভাব।
কুরআনের ভাষায় — সিজদা মানে হচ্ছে মেনে নেওয়া, বিনয় প্রকাশ করা, অহংকার ত্যাগ করা।
বন্ধুগণ!
এই অর্থই পুরো কুরআনে ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার হয়েছে।
যেমন সূরা রাহমানে বলা হয়েছে —
"وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ" (৫৫:৬)
অর্থাৎ — “গাছপালা ও নক্ষত্র সিজদা করে।”
এখানে কেউ মাটিতে পড়ে না, বরং তারা আল্লাহর আদেশমতো কাজ করে,
আল্লাহর নিয়মকে মেনে নেয় — এটিই তাদের সিজদা।
বন্ধুগণ!
সুতরাং যখন ইউসুফের পরিবার সিজদা করেছিল, তখন তারা প্রকৃতপক্ষে বলেছিল —
“হে ইউসুফ! আজ আমরা বুঝেছি আল্লাহ তোমাকে সত্যের জন্য বেছে নিয়েছেন। আমরা তোমার সিদ্ধান্তে, তোমার সত্যে আত্মসমর্পণ করছি।”
এটাই সিজদা, এবং এটাই কুরআনের গভীর ব্যাখ্যা।
বন্ধুগণ!
সবশেষে মনে রেখো —
কুরআন কখনো কাউকে মানুষের সামনে মাথা নত করতে বলে না।
বরং আল্লাহ বলেছেন —
"وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ"
(সূরা নাহল ১৬:৪৯)
অর্থাৎ — “আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুই আল্লাহর জন্য সিজদা করে।”
অতএব ইউসুফের ঘটনাও ছিল আল্লাহর জন্যই —
যেখানে ইউসুফের পরিবার ইউসুফের মাধ্যমে প্রকাশিত আল্লাহর সত্য ও হিকমাহকে মেনে নিয়েছিল,
তাঁদের অহংকার ত্যাগ করে সত্যের সামনে বিনম্র —
এটাই ছিল তাদের “সিজদা”।
বন্ধুগণ!
তাহলে আজ আমরা বুঝলাম —
ইউসুফ (আঃ)-এর প্রতি তাঁর পিতা-মাতা ও ভাইদের “সিজদা”
কোনো নামাজ বা শিরক নয়;
বরং তা ছিল সত্য, জ্ঞান ও আল্লাহর পরিকল্পনার প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
যেখানে মাথা ঝুঁকেছিল, কিন্তু আল্লাহর নামেই।
হৃদয় নত হয়েছিল, কিন্তু কেবল তাঁর নির্দেশের সামনে।
এবং এটিই হলো —
“সিজদা মানে — মেনে নেওয়া, আত্মসমর্পণ করা, সত্যের সামনে অহংকার ভেঙে দেওয়া।”

0 Comments