লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ — আল্লাহই একমাত্র বিধানদাতা
লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ
বন্ধুগণ,
আল্লাহ তাআলা বলেন —
فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ
“অতএব জেনে রাখ, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।” — (সুরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৯)
এই আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ আমাদের আদেশ দিয়েছেন — “জেনে রাখ”।
এখানে বলা হয়নি “বলে ফেল”, বা “উচ্চারণ কর”, বরং বলা হয়েছে —
“জেনে রাখ” — অর্থাৎ বুঝে, উপলব্ধি করে, বুদ্ধি খাটিয়ে, আত্মার গভীরে স্থান দিয়ে বিশ্বাস করো।
বন্ধুগণ,
এই আয়াতেই লুকিয়ে আছে ঈমানের মূল সূত্র।
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” মানে শুধু ধর্মীয় বাক্য নয়, এটি এক জীবনব্যবস্থার ঘোষণা।
যেখানে বলা হচ্ছে —
> আল্লাহই একমাত্র বিধানদাতা, আল্লাহই হুকুমদাতা,
আল্লাহই হালাল-হারাম নির্ধারণকারী, আল্লাহই শরিয়তের প্রণেতা।
যে এই সত্যকে বুঝে গ্রহণ করে — সে ঈমানদার।
আর যে শুধু মুখে বলে, কিন্তু জীবনে অন্য বিধান অনুসরণ করে,
সে আল্লাহকে “রব” মানলেও “ইলাহ” মানে না —
অতএব, তার ঈমান অসম্পূর্ণ, তার দাসত্ব বিভক্ত।
বন্ধুগণ,
“ইলাহ” শব্দটি আরবি “আলাহা” ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ —
ভালবাসা, ভয়, আনুগত্য, আত্মসমর্পণ ও বিধান মানা।
অতএব, ইলাহ মানে কেবল উপাস্য নয়, বরং সেই সত্তা যার আদেশই আইন,
যার নির্দেশই হুকুম, যার সামনে মানুষ আত্মসমর্পণ করে।
এ কারণেই “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” মানে হয় —
> “আল্লাহ ছাড়া এমন কেউ নেই যার আইন মানা হবে,
যিনি হালাল-হারাম নির্ধারণ করবেন,
যার আদেশই হবে চূড়ান্ত বিধান।”
বন্ধুগণ,
মানুষ আল্লাহকে “রব” হিসেবে মানে, কিন্তু “ইলাহ” হিসেবে মানেনা। আল্লাহর সাথে অন্যকেও ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করে।
এই ভ্রান্তি মানব ইতিহাসে নতুন নয়।
প্রাচীন মুশরিকরাও আল্লাহকে “রব” হিসেবে মানত।
কুরআন বলে —
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ
“তুমি যদি তাদের জিজ্ঞেস করো, কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও জমিন — তারা বলবে, আল্লাহ।” — (সুরা লুকমান ৩১:২৫)
অর্থাৎ তারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মানত,
তিনি রিজিকদাতা, জীবন ও মৃত্যুর মালিক, এটাও বিশ্বাস রাখতো,
তবুও তারা ছিল মুশরিক। কেন?
কারণ তারা আল্লাহর বিধান ছেড়ে অন্যের বিধান মেনে চলত।
তারা দেব-দেবীর নামে আলাদা নিয়ম বানাত,
নানা পুরোহিত, সাধু, রাজা ও নেতাদের হুকুম মানত —
অর্থাৎ আল্লাহর পাশাপাশি বহু “ইলাহ” স্থাপন করেছিল।
আজও সেই একই চিত্র মুসলিম সমাজে দেখা যায়।
মানুষ আল্লাহকে “রব” মানে — নামাজে পড়ে “রব্বুল আলামিন”,
কিন্তু জীবনে আইন মানে মানব রচিত, সমাজ চালায় মানুষের বানানো নিয়মে, অর্থনীতি চলে আল্লাহর বিধান বহির্ভুত, বিচার চলে মানব রচিত—
সব কিছু চালায় অন্য বিধান দিয়ে।
কেউ মাজহাবের ফতোয়া মানে,
কেউ নবীর নামে হাদীস দিয়ে আলাদা বিধান বানায়,
কেউ আবার মানবীয় আইন মানে —
কেউ আবার পীর বা শায়েখের ফতোয়া মানে।
কিন্তু কুরআনের বিধান হয় অবহেলিত।
আল্লাহ বলেন —
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ
“বিধান দেওয়া একমাত্র আল্লাহর কাজ।” — (সুরা ইউসুফ ১২:৪০)
এই আয়াত ঘোষণা দেয় —
মানুষ কোনোভাবেই আল্লাহর বিধানের অংশীদার হতে পারে না।
বিধান, আইন, শরিয়ত — সব কিছুর উৎস একমাত্র আল্লাহ।
আর তাই,
যে কেউ — ইমাম, আলেম, রাষ্ট্র বা ব্যক্তিগোষ্ঠী —
আল্লাহর কিতাব বাদ দিয়ে নিজস্ব নিয়ম তৈরি করে,
সে আল্লাহর অংশীদার স্থাপন করে।
আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কোনো হুকুম মানা মানে হলো —
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এর অস্বীকার।
বন্ধুগণ,
কুরআনে আল্লাহ সাবধান করে দিয়েছেন —
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَٰذَا حَلَالٌ وَهَٰذَا حَرَامٌ
“তোমাদের জিহ্বা যা মিথ্যা রচনা করে, তা দিয়ে বলো না — এটা হালাল, এটা হারাম।” — (সুরা নাহল ১৬:১১৬)
অর্থাৎ,
মানুষের ইচ্ছা, ব্যাখ্যা বা ফতোয়া দিয়ে হালাল-হারাম নির্ধারণ করা এক ভয়ংকর অপরাধ।
এটি আল্লাহর নামে মিথ্যা আরোপ করা।
আজ মুসলিম সমাজে ঠিক এই অপরাধটাই হচ্ছে।
কেউ বলে, “আমাদের ইমাম এভাবে বলেছেন, তাই এটি হারাম।”
অন্যজন বলে, “এই হাদীসে এমন আছে, তাই এটি হালাল।”
কিন্তু কুরআন বলে —
“হালাল-হারাম নির্ধারণের অধিকার কেবল আল্লাহর।”
যে অন্যকে এই ক্ষমতা দেয়, সে আল্লাহর জায়গায় অন্য “ইলাহ” বসায়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ঘোষণা করেছেন —
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا
“আল্লাহ তোমাদের জন্য শরিয়ত নির্ধারণ করেছেন, যেমন তিনি নূহের জন্য করেছিলেন।” — (সুরা আশ-শুরা ৪২:১৩)
এখানে “শারআ” শব্দটি থেকেই এসেছে “শরিয়ত” — অর্থাৎ আইন, বিধান, জীবনপথ।
আল্লাহ বলছেন — তিনিই শরিয়ত নির্ধারণ করেন।
অতএব, নবীগণ শরিয়ত প্রণেতা নন,
তারা শুধু প্রচারক।
মানুষ যদি নবীর নামে আলাদা নিয়ম তৈরি করে,
তাহলে সেটি আল্লাহর শরিয়তের বিকৃতি।
তাই, যারা আল্লাহকে, আল্লাহর কিতাবকে শরিয়তের উৎস না মেনে,
মাযহাব, হাদীস, বা রাজনীতিক আইনকে শরিয়ত মনে করে,
তারা আসলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এর বিপরীতে অবস্থান করছে।
তারা শিরকে নিপতিত বা স্পস্ট মুশরিক।
আল্লাহ বলেন —
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ
“তারা তাদের আলেম ও সাধুদের আল্লাহ ছাড়া রব বানিয়ে নিয়েছে।” — (সুরা তাওবা ৯:৩১)
বন্ধুগণ,
এই আয়াত শুধু খ্রিস্টান বা ইহুদিদের জন্য নয়।
আজ যারা আল্লাহর স্পষ্ট আয়াতকে পাশে রেখে,
ইমামের ফতোয়াকে চূড়ান্ত মনে করে —
আলেমদের ফতোয়াকে চুরান্ত ভাবে,
তাদের অবস্থাও একই।
তারা বলবে, “আমাদের ইমাম এমন বলেছেন”,
“আমাদের উস্তাদ এমন ফতোয়া দিয়েছেন” —
অথচ কুরআন কী বলছে, তা জানার প্রয়োজনও মনে করেনা।
এভাবে মানুষ অজান্তেই আলেমদের ইলাহ বানিয়ে ফেলে।
কারণ ইলাহ মানে — যার আদেশ মানা হয়।
যখন আল্লাহর আদেশ বাদ দিয়ে আলেমের আদেশ মানা হয়,
তখন আলেমই হয় ইলাহ।
---আহমাদুল্লাহর ফতোয়া
দেখুন বন্ধুগন- শায়েখ আহমাদুল্লাহ উক্ত বিষয়টি স্পষ্ট করে বললেন যে, কুরআন হাদিসের মৌলিক বিধান হলো - এটা "হারাম"। তারপর তিনি কি বললেন! তিনি বললেন- কিন্তু পর্বর্তীতে ওলামায়ে কেরামগণ একমত হয়ে তা জায়েজ বলেছেন, এজন্য আল্লাহর হারামকৃত বস্তু হালাল হয়ে গেল।
এভাবেই আলেম ও শায়েখগণ রবের আসনে বসে যান। আর মানুষ কোন সংকোচ ছাড়াই আল্লাহর বিধান হিসেবে মেনে নেয়।
বন্ধুগণ! আল্লাহকে যারা ইলাহ হিসেবে মেনে নেয়না আল্লাহ তাদেরকে কাফের বলেছেন।
এবং যারা আল্লাহর কিতাব দিয়ে ফতোয়া দেয়না তারাও কাফের। যদিও তারা বড় দাড়ি, বড় জোব্বা, আর বড় টুপি মাথায় দেয়।
আল্লাহ বলেন —
وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ
“যে আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, তা দিয়ে বিচার করে না — তারাই কাফের।” — (সুরা মায়িদা ৫:৪৪)
অর্থাৎ,
যে আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে অন্যের বিধান মেনে চলে,
সে আল্লাহকে “ইলাহ” হিসেবে অস্বীকার করছে।
তার মুখে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” থাকলেও,
তার ঈমানের মূলে ফাটল ধরে যায়।
বন্ধুগণ,
শরীয়াহ মানে আল্লাহর নির্ধারিত পথ।
কুরআন ছাড়া অন্য কোথাও শরীয়াহের উৎস নেই।
আল্লাহ বলেনঃ
“ثم جعلناك على شريعة من الأمر فاتبعها”
“তারপর আমি তোমাকে এক শরীয়াহর উপর স্থাপন করেছি, সুতরাং তুমি সেটির অনুসরণ করো।” (সূরা আল-জাসিয়া ৪৫:১৮)
কিন্তু মানুষ কুরআনের এই শরীয়াহকে বাদ দিয়ে নতুন নতুন বিধান তৈরি করেছে।
কেউ মাজহাবের নামে, কেউ হাদীসের নামে, কেউ ফতোয়ার নামে এমন সব নিয়ম বানিয়েছে যা আল্লাহর কিতাবে নেই।
এভাবে মানুষ আল্লাহকে “ইলাহ” হিসেবে নয়, বরং শুধুমাত্র “রব” হিসেবে মানে —
বন্ধুগণ,
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” — এটা মুক্তির ঘোষণা
এই কালিমা শুধু মুখের বুলি নয়;
এটি এক ঘোষণা, এক চুক্তি, এক অঙ্গীকার।
যেখানে মানুষ বলে —
> আমি আল্লাহ ছাড়া কারো আইন মানব না।
আমার শাসক আল্লাহ, আমার বিধান কুরআন।
আমি কেবল আল্লাহর আদেশেই জীবন চালাব।
এ ঘোষণার মাধ্যমে মানুষ মুক্ত হয়
মানব রচিত আইন থেকে, ধর্ম ব্যবসা থেকে,
রাজনৈতিক ফতোয়া থেকে, ও মোল্লাতন্ত্রের দাসত্ব থেকে।
বন্ধুগণ,
“রব” ও “ইলাহ” — এই দুই শব্দের সমন্বয়েই পূর্ণ ঈমান।
আল্লাহকে “রব” হিসেবে মানা মানে — সৃষ্টিকর্তা ও রিজিকদাতা স্বীকার করা।
কিন্তু আল্লাহকে “ইলাহ” হিসেবে মানা মানে —
তাঁর আইনকে একমাত্র আইন হিসেবে গ্রহণ করা।
এই দুই না মিললে ঈমান সম্পূর্ণ হয় না।
তাই কেউ যদি বলে, “আল্লাহ আমার রব,” কিন্তু
আইনের ক্ষেত্রে বলে, “আমাদের মাযহাবের নিয়মই চলবে” —
তাহলে সে আল্লাহকে “ইলাহ” মানেনি।
এভাবেই মানুষ আজ দ্বিধাবিভক্ত শিরকযুক্ত ঈমান নিয়ে বেঁচে আছে।
বন্ধুগণ,
সুরা মুহাম্মাদ ৪৭:১৯ আয়াতের প্রথম শব্দ “ফা’আলম” — “জেনে রাখ” আমাদের শেখায়,
ঈমান কোনো মুখের শব্দ নয়, এটি এক উপলব্ধি।
আর সেই উপলব্ধি তখনই পূর্ণ হয়,
যখন মানুষ বোঝে —
আল্লাহই একমাত্র বিধানদাতা, হালাল-হারামের নির্ধারক, শরিয়তের প্রণেতা, হুকুমদাতা ও ইলাহ।
আজকের মুসলমান সমাজে সবচেয়ে বড় সংকট —
মানুষ আল্লাহকে রব মানে, কিন্তু ইলাহ হিসেবে মানে না।
এ কারণেই সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য মাযহাব, হাজারো বিভক্ত ব্যাখ্যা,
যেখানে আল্লাহর কিতাব পড়ে থাকে, আর মানুষ মেনে চলে মানুষের কথা।
বন্ধুগণ,
এই কালিমা হচ্ছে সকল প্রকার মানবিক দাসত্ব থেকে মুক্তির ঘোষণা।
যখন কেউ বলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, তখন সে বলে—
“আমি কারো সামনে মাথা নত করবো না,
কারো হুকুম মানবো না,
কারো বিধান গ্রহণ করবো না —
আল্লাহ ছাড়া।”
এই কালিমা মানবজাতিকে বলে—
মানুষ তোমার রব নয়,
কোনো শাসক, কোনো ইমাম, কোনো পুরোহিত তোমার বিধাতা নয়।
কুরআনে বলা হয়ঃ
“فالله هو الولي وهو يحيي الموتى وهو على كل شيء قدير”
“আল্লাহই অভিভাবক, তিনিই মৃতকে জীবিত করেন, এবং সব কিছুর উপর তাঁরই ক্ষমতা।” (সূরা আশ-শূরা ৪২:৯)
বন্ধুগণ,
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” মুখে উচ্চারণ করা সহজ, কিন্তু বাস্তবে তা পালন করা কঠিন।
কারণ, এই কালিমা দাবি করে —
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুমের প্রতি আত্মসমর্পণ।
আল্লাহ বলেনঃ
“فلا وربك لا يؤمنون حتى يحكموك فيما شجر بينهم”
“তারা কখনোই মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তারা তোমাকে (কুরআনের বিধানকে) বিচারক বানায়।” (সূরা আন-নিসা ৪:৬৫)
অতএব, যতদিন পর্যন্ত আমরা নিজেদের হুকুম, সমাজের আইন, রাষ্ট্রের সংবিধানকে আল্লাহর বিধানের ওপরে রাখবো, ততদিন পর্যন্ত “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” শুধু জবানে থাকবে — হৃদয়ে নয়।
সমাপ্ত

0 Comments