ধর্মের নামে অনুভূতির রাজনীতি : মানুষের কণ্ঠরোধের সহজ পথ
লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ
বন্ধুগণ, এই দেশে আবার শুরু হয়েছে সেই পুরোনো খেলা—ধর্মকে ঢাল বানিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করার খেলা। একজন বাউল, যে সারাজীবন ভালোবাসার গান গেয়ে বেড়ায়, তাকে হঠাৎ করে “আল্লাহর অবমাননা”র মোড়কে গ্রেফতার করা হলো। যেন দেশটা কোনো আদালত নয়, বরং অনুভূতির থানা—যেখানে ক্ষমতাবানদের মন খারাপ হলেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে যায়। আর এই খেলাটাই এখন ধর্মরক্ষকদের পবিত্র খেলা।
বাউলদের বিরুদ্ধে নতুন করে তোলা এই ‘ইমান রক্ষা অভিযান’ আসলে কাদের জন্য? এটা কি সত্যিই ধর্ম বাঁচানোর উদ্যোগ, নাকি ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের ভয়, নিজেদের দুর্বলতাকে আড়াল করার চেষ্টা? বাউলরা তো কারো বাড়ি পুড়িয়ে দেয় না, কারো দোকান ভাঙে না, কারো অধিকার খায় না। তারা শুধু গান করে—যে গান মানুষকে নিজের ভেতরের আলো খুঁজতে শেখায়।
হা একথা ঠিক যে, আলোতো অন্ধকারের শত্রুই। তাই তো অন্ধকারের সেনারা আজ এত উত্তেজিত।
কিন্তু, বন্ধুগণ, যে দেশে ধর্মীয় অনুভূতির নামে মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়ে জেলখানায়ংল বন্ধ করা হয়, সেই দেশে কি সত্যিই অনুভূতি সমান? যদি হতো—তাহলে কোরআনের বহু আয়াত নিয়ে অমুসলিমরা আপত্তি তুলতে পারত। কোরআনে বারবার বলা হয়েছে—
“কাফিররা অন্ধকারে আছে” (বাকারা ৬)
“যারা বলে আল্লাহ তিন—তারা অবিশ্বাসী” (মায়িদা ৭৩)
“তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার” (কাফিরুন ৬)
এই আয়াতগুলো অমুসলিমদের অনুভূতিতে লাগতে পারে না? লাগতে পারে, লাগবেই। কারণ প্রত্যেক বিশ্বাসই নিজের বিশ্বাসকে সত্য মনে করে। কিন্তু তাই বলে কি কেউ কোরআন নিষিদ্ধ করে? না। কারণ সভ্য দেশগুলো বোঝে—বিশ্বাসের ভাষা, কন্ঠ রোধ করা যায়না, রোধ করতে চাইলে সবাই মিলে মিশে এক সাথে থাকা যায়নাল।
তাহলে বাংলাদেশে এই ‘অনুভূতির গর্জন’ কেন? কারণ অনুভূতি নয়—ক্ষমতার অনুভূতিই এখানে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। যার হাতে লাঠি আছে, তার কণ্ঠই নাকি আল্লাহর কণ্ঠ। যার হাতে ক্ষমতা আছে, তার দুঃখ-রাগই নাকি ধর্মের মর্যাদা। অন্য সবার অনুভূতি? সেগুলো নাকি কাগজের মতোই তুচ্ছ।
এ দেশে আলেমরা প্রতিদিন কী বলেন?
কারো ধর্মকে “ন্যায়হীন” শেরেকি,
কারো বিশ্বাসকে “বিদআত বা বিদাতি”, কারো দর্শনকে “শয়তানি”, কারো মতবাদকে “বিভ্রান্তির পথ”—এভাবে তারা মানুষের আত্মসম্মান ভেঙে চূর্ণ করে। এক ওয়াজে বলে, “হিন্দুরা নাপাক”—এভাবে কোটি মানুষের মনের ওপর আঘাত পড়ে। লল
কিন্তু রাষ্ট্র তখন কোনো মামলা দেখে না, কোনো হুমকি দেখে না, কোনো গ্রেফতারও করে না। কারণ ওদের বক্তব্য রাষ্ট্রের ব্যবহারের উপাদান—ভয় দেখানোর হাতিয়ার।
এই দেশের আইন এক চোখ খোলা রাখে ধর্মীয় নেতাদের দিকে, আরেক চোখ বন্ধ করে রাখে সাধারণ মানুষের দিকে। এখানেই সব অন্যায় ঢুকে পড়ে। এখানে অপরাধ হয় না কারো কথা দিয়ে—অপরাধ হয়ে যায় কার কথা কাকে রাগিয়ে দিয়েছে। বাউলের গান সরকারের ঘুম ভাঙিয়ে দিলে মামলা। লেখকের কলম মোল্লাদের ভ্রু কুঁচকে দিলে নিষিদ্ধ। কবির লাইনে একটু বিদ্রোহের আভাস মিললেই গ্রেফতার। কিন্তু মঞ্চে দাঁড়িয়ে কেউ যদি মানুষকে “মুরতাদ”, “জাহান্নামী”, “অবিশ্বাসী”—ইচ্ছেমতো গালি দেয়, তখন রাষ্ট্র বলে—
“এটা ধর্মীয় স্বাধীনতা!”
বন্ধুগণ, স্বাধীনতা যেখানে একপেশে,
ন্যায় সেখানে একচোখা,
আইন সেখানে পক্ষপাতদুষ্ট,
সত্য সেখানে বন্দী।
আর এই দেশ এখন সেই একই পথে হাঁটছে—যে পথে হাঁটলে চিন্তা মরে যায়, আর বেঁচে থাকে কেবল ভয়।
কিন্তু আমরা তো জানি—
যে দেশে গান ভয়ংকর হয়,
যে দেশে কবিতা অপরাধ হয়,
যে দেশে প্রশ্ন বিদ্রোহ হয়—
সে দেশে রাজনীতি অসুস্থ, ধর্ম ক্লান্ত এবং রাষ্ট্র দুর্বল।
ধর্মীয় অনুভূতির নামে আজকের এই নাটক বন্ধুরা, কোনো দেবতার ইচ্ছা নয়—এটা মানুষের বানানো খাঁচা, যেখানে বন্দী করা হয় ভিন্ন কণ্ঠ, স্বাধীন চিন্তা, এবং প্রশ্ন করার সাহস।
যারা মানুষ হয়ে ঈশ্বরের নামে মানুষের মুখ বন্ধ করে, তারা ঈমানদার নয়—তারা ক্ষমতার দালাল।
যারা সত্যকে “অপমান” বলে দোষ চাপিয়ে দেয়, তারা ধর্মরক্ষক নয়—তারা ধর্মের নামে শাসন রক্ষা করে।
বন্ধুগণ, ধর্মকে অপমান করা হচ্ছে না—
ধর্মের নামে মানুষকে অপমান করা হচ্ছে।
আল্লাহকে নয়—আল্লাহর নামে স্বাধীনতাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
এই দেশের সমস্যা বিশ্বাসের মধ্যে নয়—
সমস্যা বিশ্বাসকে ব্যবহার করে মানুষকে নীরব করার মধ্যে।
এ পৃথিবীর কোনো আলোকিত দেশ বই পোড়ায় না, গান নিষিদ্ধ করে না, প্রশ্নকে জেলে ভরে না।
কারণ তারা জানে—সমাজ টিকে থাকে যুক্তিতে, দমনে নয়।
চিন্তা টিকে থাকে স্বাধীনতায়, ভয়ে নয়।
ধর্ম টিকে থাকে মানবতায়, শাস্তিতে নয়।
যদি সত্যিই অনুভূতির বিচারই রাষ্ট্রের আইন হতো—
তাহলে পৃথিবীর অমুসলিম দেশগুলো কোরআন নিষিদ্ধ করে দিত।
কিন্তু তারা তা করেনি।
কারণ তারা জানে—
শব্দকে বন্দী করলে মানুষই পশুতে পরিণত হয়।
তাই আজ আমাদের বলতে হবে—
আমরা কারো অনুভূতি ক্ষতবিক্ষত করতে চাই না,
কিন্তু অনুভূতির নামে রাষ্ট্রের লাঠিকে বৈধতা দিতে দেবো না।
আমরা কারো বিশ্বাসকে অপমান করি না,
কিন্তু বিশ্বাসের নামে মানুষকে অপমানকারীদের সামনে নত হবো না।
আমরা ধর্ম থেকে দূরে নই—
আমরা সেই ধর্মের কাছেই দাঁড়িয়ে আছি,
যা বলে—
সত্যকে অনুসন্ধান করো,
মানুষকে সম্মান দাও,
বিচারকে ন্যায় করো।
বন্ধুগণ,
যে দেশে মানুষের কণ্ঠই অপরাধ হয়ে যায়,
সেই দেশে নীরবতাই সবচেয়ে বড় পাপ।
আর আমরা সেই পাপের অংশ হতে চাই না।
যতক্ষণ না মানুষের কথা বলার অধিকার ফিরিয়ে আনা হচ্ছে—
যতক্ষণ না অনুভূতি নয়, ন্যায় বিচার হচ্ছে—
যতক্ষণ না ধর্মের নামে ক্ষমতার বাজার বন্ধ হচ্ছে—
ততক্ষণ আমাদের কণ্ঠ থামবে না।
কারণ, এই ভূমি গান দিয়ে জেগেছে,
কবিতা দিয়ে জেগেছে,
চিন্তা দিয়ে জেগেছে—
এই ভূমিকে আবার সেভাবেই জাগাতে হবে।
আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো ওঠে শুধুই তখন—
যখন মানুষ ভয়কে অস্বীকার করে বলে—
“আমার কণ্ঠ আমারই।
এটা কোনো মোল্লার দান নয়,
কোনো সরকারের অনুগ্রহ নয়।”
বন্ধুগণ, সেই কণ্ঠ ফিরে পেতে
আজ আমাদেরই কথা বলতে হবে।
0 Comments