সুরা যুমারের ৬৫ আয়াত ও সুরা যিলযালের ৭-৮ আয়াত কি পরস্পর বিরোধী?
সম্মানিত ভাই! আরো কয়েকটি চমৎকার প্রশ্ন করেছেনঃ- তার মধ্যে এখন আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দিব ইনশাআল্লাহ। এই প্রশ্নটি কেবল একটি তাফসিরি বিষয় নয়, বরং বিশ্বাসের গভীর দিক উন্মোচন করে—তিনি প্রশ্ন করেছেনঃ-
“শিরক করলে সব আমল নষ্ট হয়” — এর মানে আসলে কী? সবকিছুই কি মুছে যায়? আর কিয়ামতের দিন তো বলা হয়েছে, মানুষ তার প্রতিটি কাজ, ছোট হোক বা বড়, দেখতে পাবে! তাহলে দুটি আয়াতের মধ্যে সমন্বয় করবো কিভাবে?
চলো, বন্ধুগণ! আমরা বিষয়টি গভীরভাবে সহজে বুঝে নিই—
বন্ধুগণ!
প্রথমে দেখি সেই আয়াতটি যেখানে আল্লাহ বলেন:
"وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ"
(সূরা যুমার ৩৯:৬৫)
অর্থ: “তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি ইতিমধ্যেই অহী করা হয়েছে যে, যদি তুমি শিরক করো, তাহলে তোমার সকল আমল নিশ্চয়ই নষ্ট হয়ে যাবে, আর তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”
এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হলো— শিরক করলে সব আমল নষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু অন্যদিকে আল্লাহ আবার বলেন—
"فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ، وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ"
(সূরা যিলযাল ৯৯:৭-৮)
অর্থ: “যে অতি সামান্য পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে; আর যে অতি সামান্য পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সেও তা দেখতে পাবে।”
এখন প্রশ্ন—
যদি শিরক করলে সব আমলই নষ্ট হয়ে যায়, তবে কিয়ামতের দিনে সে কিভাবে তার ভালো-মন্দ কাজগুলো “দেখবে”?
বন্ধুগণ!
এই রহস্যের উত্তর কুরআনের ভেতরেই আছে— শুধু বোঝার দরকার আছে “কোন দৃষ্টিকোণ থেকে” আয়াতগুলো বলা হয়েছে।
প্রথম আয়াত (যুমার ৬৫) বলছে “চূড়ান্ত ফলাফলের” কথা —
অর্থাৎ, যারা শিরক অবস্থায় মারা যায়, তাদের জীবনের সব সৎকর্মের কোনো ওজন থাকবে না পরকালের বিচারে।
কিন্তু দ্বিতীয় আয়াত (যিলযাল ৭–৮) বলছে “বিচার প্রক্রিয়ার” কথা —
অর্থাৎ, কিয়ামতের দিনে প্রত্যেকে তার প্রতিটি কাজ দেখতে পাবে, যেন বুঝতে পারে সে কেমন জীবন কাটিয়েছে।
তাহলে এখানে “দেখা” আর “প্রাপ্তি”— এই দুই বিষয়কে আলাদা করে বুঝতে হবে।
বন্ধুগণ!
শিরক করলে আমল “নষ্ট” হয়ে যায় মানে এই নয় যে, কিয়ামতের দিন সেই কাজগুলো দেখা যাবে না।
বরং অর্থ হলো— সেই কাজগুলো আর পুরস্কারযোগ্য থাকবে না, তা বাতিল হবে।
যেমন ধরো, কেউ অনেক দান-সদকা করল, মানুষকে সাহায্য করল, কিন্তু সারা জীবন অন্য দেবতার উপাসনা করল বা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করল।
তাহলে কিয়ামতের দিনে তার সেই দান বা সৎকর্ম অবশ্যই রেকর্ডে থাকবে, সে নিজেও তা দেখবে, কিন্তু যখন ফলাফল দেওয়া হবে, তখন আল্লাহ বলবেন—
“তুমি তোমার প্রতিদান তো দুনিয়াতেই পেয়ে গিয়েছিলে; প্রশংসা, সম্মান, নাম— সবই পেয়ে গেছো।”
অর্থাৎ, তার কাজ মুছে যায়নি, কিন্তু পরকালের পুরস্কারের যোগ্যতাটা নষ্ট হয়ে গেছে।
বন্ধুগণ!
এটা ঠিক যেমন কেউ পরীক্ষায় অনেক কিছু লিখেছে, কিন্তু উত্তরপত্রের উপরে নিজের নামের জায়গায় ভুল রোল নম্বর লিখেছে—
ফলাফল ঘোষণার সময় সেই খাতা অবৈধ গণ্য হয়।
খাতার ভেতরের লেখা তো ছিলই, কিন্তু পরীক্ষক তা গণনায় নেন না।
ঠিক তেমনি, শিরক মানে হলো “ভুল রোল নম্বর লেখা”— তুমি সব ভালো কাজ করেছো, কিন্তু যাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তা করেছো, সে আল্লাহ ছিলনা ছিলো অন্য কেউ।
বন্ধুগণ!
চলুন এখন দ্বিতীয় দিকটা দেখি — কিয়ামতের দিন সবাই নিজের ছোট-বড় কাজ দেখবে।
এই আয়াতটি আল্লাহ বলেছেন শিক্ষা ও বিচার প্রদর্শনের জন্য।
মানুষ যাতে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে — তার জীবন কেমন ছিল।
যারা শিরক করেনি, তাদের আমল দেখা হবে, ওজন করা হবে, পুরস্কারও দেওয়া হবে।
কিন্তু যারা শিরক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের সামনে আমল নামা শুধু প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হবে, যাতে তারা অস্বীকার করতে না পারে।
তখন আল্লাহ বলবেন —
“এগুলোই তো তোমার কাজ ছিল, তুমি এগুলো করেছিলে, কিন্তু যেহেতু তুমি অন্যদের আমার সাথে শরীক করেছিলে, তাই আজ এর কোনো ওজন থাকবে না।”
অর্থাৎ, দেখা থাকবে, কিন্তু পুরস্কার থাকবে না।
বন্ধুগণ!
একটা উদাহরণ দিই—
ধরা যাক, কেউ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, দেশদ্রোহী হয়।
তার আগে সে হয়তো অনেক ভালো কাজ করেছিল— স্কুল বানিয়েছে, হাসপাতাল করেছে।
কিন্তু যখন রাষ্ট্রদ্রোহ প্রমাণিত হয়, তখন রাষ্ট্র তার সব পুরস্কার, পদক, সম্মাননা বাতিল করে দেয়।
তবুও ইতিহাসে তার কাজগুলোর রেকর্ড থাকে— কেউ তা মুছে দেয় না।
ঠিক তেমনি, আল্লাহর রাজত্বে শিরক হচ্ছে “রাষ্ট্রদ্রোহ”।
যে এটি করে এবং তওবা না করে মারা যায়, তার সব সৎকর্ম বাতিল হয়ে যায়, যদিও রেকর্ডে তা থাকবে।
বন্ধুগণ!
এখন আসো, “আমল নষ্ট হওয়া” কথাটির কুরআনিক অর্থ দেখি।
“حَبِطَ” (হাবিতা) শব্দটি এসেছে “হাবাত” থেকে, যার অর্থ — ফলহীন হয়ে যাওয়া বা অর্থহীন হয়ে পড়া।
এটা “মুছে ফেলা” নয়, বরং “ফল না পাওয়া” বোঝায়।
যেমন— গাছের চারা লাগানো হলো, কিন্তু কেউ সার না দিল, পানি না দিল— গাছটা শুকিয়ে গেল।
চারা তো ছিল, কিন্তু ফল হলো না।
এটাই “হাবিত আমল” — কাজটা করেছো, কিন্তু উদ্দেশ্য ও ঈমানের অভাবে ফলাফল হারিয়ে ফেলেছো।
বন্ধুগণ!
তবে মনে রেখো, আল্লাহর করুণা অসীম।
যদি কেউ শিরকের পর তওবা করে, তার আগের সব ভুল আল্লাহ মাফ করে দেন।
তখন সেই নষ্ট আমলও পুনরায় গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।
কুরআন বলে—
“যদি তারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, তবে আমি তাদের মন্দ কাজগুলোকে সৎকর্মে পরিণত করে দেব।” (সূরা ফুরকান ২৫:৭০)
অর্থাৎ, আল্লাহর দরজায় ফিরে আসা মানেই নতুন জীবন পাওয়া।
বন্ধুগণ!
তাহলে এখন সমন্বয়টা পরিষ্কার হলো—
যারা শিরক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাদের আমলগুলো কিয়ামতের দিন দেখা যাবে ঠিকই, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হবে না।
তাদের জন্য তা হবে “প্রমাণ”, পুরস্কার নয়।
আর যারা ঈমান নিয়ে মারা যায়, তাদের প্রতিটি কাজের হিসাব হবে ন্যায়বিচারের সঙ্গে, সামান্যতম ভালো কাজও ব্যর্থ হবে না।
বন্ধুগণ!
সুতরাং, “শিরক করলে সব আমল নষ্ট হয়ে যায়” মানে— তোমার জীবনের প্রতিটি ভালো কাজ, দান, ইবাদত— সবকিছু পরকালের পুরস্কার থেকে বাতিল হয়ে যায়, যদি তুমি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে মারা যাও।
আর “প্রত্যেকে নিজের কাজ দেখতে পাবে”— মানে, বিচার দিবসে কেউ বলতে পারবে না “আমি তো কিছুই করিনি।”
সব রেকর্ড সামনে হাজির করা হবে— যেন মানুষ নিজেই নিজের অপরাধ স্বীকার করে।
বন্ধুগণ!
শেষ কথা হলো—
আমল নষ্ট হয় তখনই, যখন বিশ্বাস নষ্ট হয়।
শিরক সেই বিশ্বাসের মূলেই আঘাত করে।
তুমি যতই ফুল ফোটাও, যদি মূল পচে যায়, পুরো গাছটাই শুকিয়ে যায়।
ঠিক তেমনি, শিরক মানে হলো বিশ্বাসের মূল পচে যাওয়া— ফলে সব আমল নিষ্ফল হয়ে পড়ে।
কিন্তু আল্লাহর দিকে ফিরে আসলে, সেই শুকনো গাছ আবার সবুজ হয়—
কারণ আল্লাহর রহমত এমন এক বৃষ্টি, যা মরা হৃদয়কেও জাগিয়ে তোলে।

0 Comments