Subscribe Us

বিবেক নিভে গেলে শয়তান সঙ্গী হয়— কুরআনের নিয়মের গভীর বিজ্ঞান”

 

বিবেক নিভে গেলে শয়তান সঙ্গী হয়— কুরআনের নিয়মের গভীর বিজ্ঞান”
লিখকঃ- মাহাতাব আকন্দ
বন্ধুগণ! মানুষের জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা হলো—ভুল পথকে ঠিক পথ মনে করা। আর তার চেয়েও ভয়ংকর হলো—ভুলকে নিজের সঙ্গী বানিয়ে ফেলা। এই ভয়ংকর সত্যটি আল্লাহ অত্যন্ত শক্ত ভাষায় বলেছেন ৪৩:৩৬ নম্বর আয়াতে:

﴿وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَٰنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ﴾

বন্ধুগণ, আয়াতটি শুধু ধর্মীয় বক্তব্য নয়, এটি মানুষ ও মনস্তত্ত্বের গভীর বাস্তবতা। এখানে একটি শক্তিশালী নিয়ম ঘোষণা করা হয়েছে—"যে রহমানের কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমরা তার জন্য এক শয়তান নির্দিষ্ট করি—সে তার সঙ্গী হয়ে যায়।"

আজ আমরা বুঝবো—
এই "শয়তান লাগিয়ে দেওয়া" বলতে কি বুঝায়?
এটি কি জোর করে দেওয়া?
এটি কি শাস্তি?
এটি কি আল্লাহর দয়া থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া?
না—এটি কী তাহলে?

বন্ধুগণ! প্রথমেই পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন—এই আয়াত ভুল বুঝলে মনে হবে আল্লাহ যেন কাউকে জোর করে পথভ্রষ্ট করেন। কিন্তু আয়াতের ভেতরে যে রহস্য আছে, তা পুরোটা বুঝলে আপনি দেখবেন—এটি কোনো জোর নয়, বরং স্বাভাবিক পরিণতি, প্রকৃতির আইন, আল্লাহর সুন্নাহ, সুন্নাতাল্লাহ

বন্ধুগণ!
আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ বলেছেন—
﴿وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ الرَّحْمَٰنِ﴾
—“যে রহমানের স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়…”

বন্ধুগণ! গভীর মনযোগ দিন। এখানে প্রথম কাজটি কার?
মানুষের।
আল্লাহ বলেননি—“যাকে আমি কুরআন থেকে সরিয়ে দিই।”
আল্লাহ বলেন—“যে নিজে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”
অর্থাৎ, আলো থেকে সরে যাওয়া শুরুটা মানুষের নিজের।

এটা ঠিক যেমন-
আপনি দরজা জানালা বন্ধ করলে ঘরতো অন্ধকার হবেই।
আপনি গাছের গোড়ায় পানি না দিলে গাছ শুকিয়ে মারা যাবেই।
আপনি বাইে তেল না দিলে বাইক বন্ধ হবেই।

কিন্তু কেউ যদি বলে—“দেখো, বাইক বন্ধ হয়েছে এটা বাইকের মালিকের দোষ নয়, বরং বাইক কম্পানির দোষ।
তাহলে কথাটা কি ঠিক হবে?
না। এটাই নিয়ম।
বন্ধুগণ!
এখানেও ঠিক তাই।
এটা শাস্তি নয়—এটা ফলাফল।
তুমি গাছের গোড়ায় পানি দেওনি,
কে পানি দেয়নি?  তুমি দেওনি, দোষী কে?  অবশ্যই তুমি।
পানি না পেয়ে গাছ মাড়া গেলো,
এই যে মৃত্য এটার মালিক কে? আল্লাহ।
আল্লাহই মৃত্য ঘটান এবং জিবন দেন। এটাই আল্লাহর সুন্নাহ বা নিয়ম।
এখানে দোষী তুমি, কারণ তুমি গাছের গোড়ায় পানি দেওনি।  যার কারণে গাছ মরতে বাধ্য।
এখানে আল্লাহ বলতেই পারেন যে, আমিই গাছটির মৃত্যু দিয়েছি।  কারণ মৃত্যর মালিকতো তিনিই।

বন্ধুগণ! হৃদয়ের আলোর নাম কুরআন।
জীবনের পথ দেখানোর নাম কুরআন(ذِكْر)।
যে সেটা থেকে দূরে যায়—তার হৃদয় স্বাভাবিকভাবেই অন্ধকারে ডুবে যায়।
এই অন্ধকারকে কুরআন এক শব্দে বলেছে — “شَيْطَانًا”

খেয়াল করুন—এটি বাহির থেকে আসা কোনো মহাজাগতিক দানব নয়।
এটি জন্ম নেয় আমাদের ভিতরের অজ্ঞতায়, অবহেলায়অহঙ্কারে

যেমন—
লোহাকে আপনি যদি ব্যবহার না করেন—
তার ওপর মরিচা ধরবেই।
এই মরিচাকে আপনি দোষ দেবেন নাকি নিজের অবহেলাকে?

বন্ধুগণ!
এখন বলুন—
মরিচা ধরার প্রাকৃতিক নিয়ম যেহেতু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন—
তাহলে আল্লাহ বলতে পারেন কি—
“আমিই মরিচা ধরাই”?
হ্যাঁ, পারেন।

কারণ এটাই তাঁর স্থাপিত নিয়ম।
তেমনি—
আল্লাহ বলতে পারেন:

﴿نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا﴾
—“আমি তার জন্য এক শয়তান লাগিয়ে দেই।”
এর মানে হলো—
আল্লাহ তার নিয়ম কার্যকর করেন।
মানুষ নিজের কাজের ফল পায়।

বন্ধুগণ! কুরআনের ভাষায় “শয়তান” সবসময়ই অদৃশ্য জ্বিন না।
যে কোনো—
• ভুল চিন্তা
• অহঙ্কার
• মিথ্যা বিশ্বাস
• প্রবণতার বিকৃতি
• অন্ধ অনুসরণ
• ভুলকে ঠিক মনে করা
• সত্যকে হাস্যকর ভাবা
• নিজের মতামতকে ঈমান বানানো
—এগুলোই শয়তান।

অর্থাৎ মরিচা ধরা হৃদয়ই হলো শয়তান।

যেমন—একটি লোহার টুকরা আপনাকে কামড়ায় না।
কিন্তু তার ওপর জমা হওয়া মরিচা তাকে দুর্বল বানিয়ে দেয়।
মরিচাই তাকে ধ্বংস করে।
হৃদয়ে শয়তান এভাবেই কাজ করে।

বন্ধুগণ! কুরআন বলছে—
“فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ”
—“সে শয়তান তার সাথী হয়ে যায়।”
কোনো কিছু একদিনে সঙ্গী হয় না।
সঙ্গী হয় বারবার ব্যবহারের ফলে।

আপনি যদি ভুলকে বারবার গ্রহণ করেন—
ভুল আপনার সঙ্গী হবে।

আপনি যদি সত্যকে বারবার ফেলে দেন—
মিথ্যা আপনার সঙ্গী হবে।

আপনি যদি অন্ধকারে থাকেন—
অন্ধকার আপনার সঙ্গী হবে।

এটাই আয়াতের “قَرِينٌ”—
অর্থাৎ চিন্তার সঙ্গী, আচরণের সঙ্গী, অন্তরের সঙ্গী, ব্যক্তিত্বের সঙ্গী

বন্ধুগণ!
কুরআন শতবার বলেছে—
“يَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ أَنَابَ”
—“যে ফিরে আসে, আল্লাহ তাকে পথ দেখান।”

আরেক জায়গায়—
“فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ”
—“তারা যখন সরলো—তখন আল্লাহ তাদের অন্তরকেও সরিয়ে দিলেন।”
এখানে জোর কোথায়?
“তারা যখন সরল”—এটাই মূল।
অতএব ৪৩:৩৬ আয়াতটি কোনো বাধা নয়—
এটি মানুষের নিজের পছন্দের প্রাকৃতিক পরিণতি

বন্ধুগণ! আজকের পৃথিবীতে ৪৩:৩৬ আয়াতের সবচেয়ে বাস্তব উদাহরণ হলো—
YouTube Algorithm

এবার শোনেন—
আপনি যদি একবার ভুল, মিথ্যা, ষড়যন্ত্র, অদ্ভুত, অন্ধ বিশ্বাসের ভিডিও দেখেন—
ইউটিউব সঙ্গে সঙ্গে ভাববে—
“বাহ! এটাই তোমার পছন্দ? নাও তবে আরও দেখো!”

তারপর আপনাকে একই ধরনের আরও ভিডিও দেখাবে।
আরও আরও দেখাবে।
আরও আরও দেখাবে।

ক্রমে কী হবে?
একসময় আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করবেন—
এটাই সত্য!
এটাই বাস্তব!

বন্ধুগণ!
আপনি নিজেই ক্লিক করে ভুল পথে প্রথম ধাপ ফেলেছেন।
কিন্তু ইউটিউব অ্যালগরিদম আপনার সেই পথে আরও পাথর বিছিয়ে দিয়েছে।
আরও কনটেন্ট এগিয়ে দিয়েছে।
এখন আপনি ভুলের পথে যাচ্ছেন—
এবং আপনাকে নিজেই মনে হচ্ছে—

“আমি তো ঠিকই আছি!”
“এটাই তো সঠিক তথ্য!”
“আমি তো গবেষণা করেছি!”

এই অ্যালগরিদমই আপনার “قَرِينٌ”—
অর্থাৎ সঙ্গী

এটাই কুরআনের ভাষায়—
﴿فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ﴾

বন্ধুগণ!
আপনার ভুল পছন্দই অ্যালগরিদমকে শক্তি দিয়েছে আপনাকে ভুল পথে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে।
এটা কি অ্যালগরিদমের জোরজবরদস্তি ছিল?
না!
এটা আপনার নিজের কাজের ফল।

এটাই আয়াতের অর্থ—
“نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا”
—“আমরা তার জন্য একটি শয়তান নির্দিষ্ট করি।”
অর্থাৎ—
যে ভুলে পা বাড়ায়—ভুল তাকে সঙ্গী দিয়ে দেয়।

যেমন—
আপনি ভুল ভিডিও খুললেন—
অ্যালগরিদম বললো—“ঠিক আছে, নাও আরও!”
আপনি ভুল চিন্তা ধরলেন—
আল্লাহর স্থাপিত নিয়ম বললো—“ঠিক আছে, নাও আরও!”
এটাই ৪৩:৩৬।

বন্ধুগণ, বলুন তো—
এখন কি আয়াতটি কঠোর মনে হয়?
না—এটি ১০০% যৌক্তিক।

বন্ধুগণ! আপনি নিজেই ভেবে—
যদি লোহাকে ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হয়—
এটা মরিচা ধরবে।

মরিচা ধরে কি?
লোহার নিজের অজ্ঞাতসারে?
না—প্রকৃতির নিয়মে।

এখন যদি কেউ বলে—
“মরিচা ধরেছে, মানে আল্লাহ মরিচা লাগিয়েছেন”—
এটা কি ভুল কথা?
না!
কারণ মরিচা ধরার নিয়ম তিনিই সৃষ্টি করেছেন।

ঠিক তেমনি—
যদি কেউ কুরআন থেকে দূরে যায়—
তার ভেতর অন্ধকার জমে।
এটা পুরোপুরি প্রাকৃতিক নিয়ম।

এবং এই অন্ধকারকে আল্লাহ বলেছেন—
“شَيْطَانًا”
—ভুল পথের সঙ্গী।


বন্ধুগণ! এই আয়াতকে যদি সহজ ভাষায় বলি—
“যে আলো থেকে দূরে যায়, অন্ধকার তার সঙ্গী হয়ে যায়।
এটা কোনো শাস্তি নয়—এটা নিয়ম।”

বন্ধুগণ! এই আয়াতের আসল ভয় এখানেই—
মানুষ ভুল পথে চলতে থাকে—
আর তার ভেতরের সেই শয়তানি সঙ্গী তাকে বলে—

“তুমি ঠিক করছ!”
“তোমার পথ ঠিক!”
“তোমার মতামতই সঠিক!”

এটা কুরআনের ভাষায়—
﴿وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُم مُّهْتَدُونَ﴾
—“তারা মনে করে—তারা ঠিক পথে আছে!”
এটাই ইউটিউব অ্যালগরিদমের শেষ ধাপ—
আপনি ভুলে ডুবে গেছেন—
কিন্তু মনে হচ্ছে—আমি গবেষণা করছি!
এই ভুল ধারণাই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় অন্ধত্ব।

তাহলে সমাধান কী?
বন্ধুগণ!
প্রথম ধাপ সরে যাওয়া মানুষের—
তাই ফিরতেও হবে মানুষের।

যে ফিরে আসতে চায়—
তার জন্য দরজা খোলা।

আল্লাহ বলেন—
“وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا”
—“যারা চেষ্টা করে—আমরা তাদের পথ দেখাই।”
এটাই সমাধান—
আলোয় ফিরে আসা।
কুরআনে ফিরে আসা।
মরিচা ঝেড়ে ফেলা।

বন্ধুগণ!
৪৩:৩৬ আয়াতের কঠোরতা নয়—
এর ভেতরের সত্য জাগার মতো।

এটি বলছে—

তুমি যদি আলো ফেলে দাও—
অন্ধকার তোমার সঙ্গী হবেই।

তোমার নির্বাচিত পথই তোমার সঙ্গী তৈরি করবে—
হোক তা কুরআনের আলো,
বা ইউটিউবের ভুল অ্যালগরিদম,
বা তোমার ভেতরের জং ধরা চিন্তা।

যে কুরআন ধরে—
তার সঙ্গী হয় নূর।
যে কুরআন ছেড়ে দেয়—
তার সঙ্গী হয় অন্ধকার।
এটাই আল্লাহর ন্যায়বিচারের নিয়ম। 

Post a Comment

0 Comments