আমরা মাঝে মাঝে কিছু ভয়ংকর প্রশ্নের মুখোমুখি হই—এমনি কিছু ভয়ংকর ভয়ংকর প্রশ্ন করেছেন আমাদের এক ভাই- তিনি জানতে ও মানতে আগ্রহী তাই তার প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে উপস্থিত হলাম। আমি এমন লোকের প্রশ্নের উত্তর দেইনা, যারা সত্য জানার পরেও তা মেনে নেয়না বরং নিজের প্রভুত্ব ও অহংকার ধরে রাখে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, আল্লাহ বলেছেন, “জলে ও স্থলে যে বিপর্যয় ঘটে, তা মানুষের হাতের কাজের ফল।” কিন্তু তখন তো দেখা যায়, বন্যায় ডুবে যায় গ্রামের শিশুরা, জ্বলে যায় গাছপালা, মরে যায় পশুপাখি। অথচ তারা তো কোনো অন্যায় করেনি! তাহলে কি এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে জুলুম নয়?
— না বন্ধুগণ, এটা জুলুম নয়। বরং এই ঘটনাগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে আল্লাহর অগাধ প্রজ্ঞা, এক গভীর শিক্ষা, যা মানুষকে ফেরানোর জন্যই আল্লাহ দেখান।
বন্ধুগণ! চলো, আয়াতটি ভালো করে দেখি। সূরা রূমের ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন— “জলে ও স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে মানুষের হাতের কাজের কারণে; যাতে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের কিছু অংশের ফল আস্বাদন করান, যেন তারা ফিরে আসে।” এখানে লক্ষ্য করো, আল্লাহ বলেননি— “আমি তাদের সব কর্মফল দিচ্ছি”, বরং বলেছেন— “তাদের কিছু অংশের ফল আস্বাদন করাই।” অর্থাৎ, দুনিয়ার দুর্যোগ ও বিপর্যয় হচ্ছে একধরনের সতর্কবার্তা, চূড়ান্ত শাস্তি নয়। যেন মানুষ নিজের ভুল বুঝে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।
বন্ধুগণ! তাহলে প্রশ্ন আসে— যেসব শিশু, পশু, গাছপালা বা অন্য প্রাণী এই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের অপরাধ কী? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আল্লাহর প্রতিষ্ঠিত নিয়মে। এই দুনিয়ায় আল্লাহ দুটি নিয়মে কাজ করেন— একটি ব্যক্তিগত বিচারব্যবস্থা, আরেকটি প্রাকৃতিক বা সমষ্টিগত ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত বিচার হবে কিয়ামতের দিনে, যেখানে প্রত্যেকে নিজের কাজের পূর্ণ ফল পাবে। কিন্তু এই দুনিয়ায় ঘটনাগুলো তিনি ঘটান প্রাকৃতিক নিয়মের মাধ্যমে— যা সবার উপর সমান ভাবে প্রভাব ফেলে।
বন্ধুগণ! ধরা যাক, একটি জাতি নদী দূষণ করলো, গাছ কেটে ফেললো, বন ধ্বংস করলো, কারখানার ধোঁয়ায় বাতাস বিষাক্ত করলো— তখন তার প্রভাব তো শুধু অপরাধীদের গায়ে পড়ে না, পড়ে সবার গায়ে। নদীর পানি বিষাক্ত হলে তো নিরপরাধ শিশুরাও তা পান করে অসুস্থ হবে; পাখিরাও সেই পানিতে ডুবে মারা যাবে; গাছও শুকিয়ে যাবে। এটা আল্লাহর জুলুম নয়, এটা মানুষের কাজের স্বাভাবিক ফলাফল।
যেমন তুমি আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে— আল্লাহ সেই নিয়ম স্থাপন করেছেন। এখন যদি কেউ বলে, “হাত পুড়লো, এটা জুলুম”— তা হবে ভুল কথা, কারণ আল্লাহ আগে থেকেই সতর্ক করেছেন আগুন পোড়ায়। ঠিক তেমনি মানুষ যদি পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে, তার ফলেও বিপর্যয় আসবে— এটা আল্লাহর নিয়ম, এবং নিয়ম ভাঙলে তার প্রতিক্রিয়া আসবেই।
বন্ধুগণ! আল্লাহর ন্যায়বিচার মানে এই নয় যে, তিনি দুনিয়ায় সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীর শাস্তি দেবেন আর নিরপরাধ ব্যাক্তিদের সুরক্ষা করবেন। বরং দুনিয়া হলো পরীক্ষা। এখানে শাস্তি নয়, শিক্ষা প্রধান। তাই আল্লাহ দুনিয়ায় যখন কোনো বিপর্যয় ঘটান, তা আসলে “আযাব” নয়, বরং “সতর্কবার্তা”। কুরআন বলে— “আমি নিদর্শন পাঠাই কেবল ভয় দেখানোর জন্য।” (সূরা ইসরা ১৭:৫৯) অর্থাৎ আল্লাহ এমন বিপর্যয় ঘটান, যাতে মানুষ ভয় পায়, চিন্তা করে, আর নিজের পথ ঠিক করে নেয়।
বন্ধুগণ! শিশুদের, পশুপাখিদের এবং গাছপালার মৃত্যু আমাদের চোখে কষ্টকর, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে তা অন্যায্য নয়। কারণ তাদের মৃত্যু হচ্ছে সাময়িক ক্ষতি, চিরস্থায়ী নয়। গাছ শুকিয়ে গেলে তার জায়গায় নতুন গাছ জন্মায়, প্রাণী মরে গেলে নতুন প্রজন্ম জন্ম নেয়। পৃথিবীর এই পুনর্জীবনের চক্রটাই প্রমাণ করে, এটি কোনো অন্যায় নয়, বরং এক প্রাকৃতিক শিক্ষা। আর যে শিশু মারা যায়, সে তো আল্লাহর কাছে নির্দোষ, সে জান্নাতে যাবে— তার কোনো ক্ষতি হয় না। বরং সেই ঘটনাই হয়তো অন্যদের হৃদয়ে দয়া জাগিয়ে তোলে, অন্যায় থেকে বিরত রাখে।
বন্ধুগণ! দুর্যোগ আসলে আল্লাহর এক ধরনের দৃষ্টি আকর্ষণ। মানুষ যতদিন আরাম-আয়েশে থাকে, ততদিন আল্লাহকে ভুলে যায়। কিন্তু যখন বন্যা আসে, মহামারি ছড়ায়, খাদ্য সংকট হয়— তখন মানুষ ভাবে, “আমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।” আল্লাহ বলেন— “আমরা তাদের কষ্ট ও দুর্দশায় ফেলেছিলাম, যেন তারা নম্র হয়ে ফিরে আসে।” (সূরা আনআম ৬:৪২) অতএব, এই দুর্যোগগুলো মানুষকে নিজের সীমাবদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দেয়— যে, সে সর্বশক্তিমান নয়, বরং এক পরম শক্তির অধীন।
বন্ধুগণ! তুমি যদি ভাবো, “তাহলে তো শিশুরাও কষ্ট পাচ্ছে”— মনে রেখো, শিশুরা এই পৃথিবীতে পরীক্ষার জন্য আসেনি, তারা নিষ্পাপ। তাদের মৃত্যু মানে কোনো শাস্তি নয়, বরং জান্নাতের নিশ্চয়তা। আল্লাহ কাউকে বিনা কারণে কষ্ট দেন না। কখনো কখনো এক নির্দোষ শিশুর মৃত্যু হয়তো হাজার মানুষকে তওবা করিয়ে দেয়, হাজার হৃদয়কে কোমল করে তোলে। সেই একটি ঘটনা সমাজের বিবেককে জাগিয়ে তোলে— তাই এটি ‘অন্যায়’ নয়, বরং বৃহত্তর কল্যাণের একটি মাধ্যম।
বন্ধুগণ! কুরআন সর্বত্রই বলে, আল্লাহ কখনোই জুলুম করেন না। “তোমার রব কখনোই তাঁর বান্দাদের প্রতি অন্যায়কারী নন।” (সূরা ফুসসিলাত ৪৬) যা কিছু ঘটে, তা তাঁর নির্ধারিত নিয়মের মধ্যে হয়। এই নিয়ম এমন যে— যখন মানুষ অন্যায় করে, তখন তার প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া পুরো পৃথিবীর উপর ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, এক নদী দূষিত হলে তার পানি কেবল কারখানার মালিককেই নয়, পুরো এলাকার মানুষকেই ক্ষতি করে। কিন্তু এই ক্ষতিটাই যেন মানুষকে জাগিয়ে তোলে, যেন তারা বুঝতে পারে— “আমাদের লোভ ও অবহেলায় আমরা নিজেরাই এই বিপর্যয় ডেকে এনেছি।”
বন্ধুগণ! এই পৃথিবী এক ভারসাম্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ যদি সেই ভারসাম্য ভাঙে, তাহলে আল্লাহ সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনেন— কখনো বন্যা দিয়ে, কখনো আগুন দিয়ে, কখনো ঝড় দিয়ে। এটা জুলুম নয়, বরং আল্লাহর ন্যায়বিচারেরই এক রূপ, যেখানে তিনি প্রকৃতির নিয়মকে অবিকৃত রাখেন। যেমন— যদি একটি সমাজে মিথ্যা, প্রতারণা, লোভ, অন্যায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ সেই সমাজকে নাড়িয়ে দেন, যেন মানুষ নিজের অবস্থান দেখে জেগে ওঠে।
বন্ধুগণ! সুতরাং, যখন আমরা দেখি দুর্যোগে শিশুর মৃত্যু, প্রাণীর মৃত্যু, গাছের মৃত্যু— তখন আমাদের কাঁদা উচিত, কিন্তু আল্লাহকে দোষ দেওয়া নয়। বরং ভাবা উচিত— আমরা কী করেছি, যার ফলে এই পৃথিবীর সৌন্দর্য মলিন হয়ে যাচ্ছে। এই কষ্ট আমাদের জন্যই আয়না— যেন আমরা নিজেদের আচরণ দেখে বুঝি, আল্লাহর বিধান থেকে আমরা কতটা দূরে চলে গেছি।
বন্ধুগণ! দুনিয়ার বিপর্যয় কোনো চূড়ান্ত বিচার নয়। চূড়ান্ত বিচার হবে কিয়ামতের দিনে, যেখানে প্রত্যেকে নিজের কাজের পূর্ণ হিসাব পাবে। সেখানে কেউ অন্যের বোঝা বহন করবে না। আর এই দুনিয়ার বিপর্যয়গুলো শুধু স্মরণ করিয়ে দেয়— “ফিরে এসো, তোমাদের স্রষ্টার পথে।”
তাই আমাদের উচিত প্রতিটি দুর্যোগের পর নিজেকে প্রশ্ন করা— আমি কি সেই মানুষের দলে, যারা এই অন্যায়ের কারণ? নাকি আমি সেই দলে, যারা আল্লাহর পথে ফিরে আসতে চায়?
বন্ধুগণ! আল্লাহ জুলুম করেন না। মানুষের কাজেই পৃথিবী দূষিত হয়, ভারসাম্য নষ্ট হয়, দুর্যোগ আসে। আল্লাহ সেই দুর্যোগের মধ্য দিয়ে মানুষকে শিক্ষা দেন, সতর্ক করেন, এবং সুযোগ দেন— যেন সে তওবা করে ফিরে আসে। আর যারা সেই শিক্ষা নেয়, তাদের জন্য এই বিপর্যয়ই হয় রহমত; আর যারা অন্ধ হয়ে যায়, তাদের জন্য হয় ধ্বংসের পূর্বাভাস।
0 Comments