Subscribe Us

কুরআনের দৃষ্টিতে “জমি বন্ধক

 

কুরআনের দৃষ্টিতে “জমি বন্ধক
লিখকঃ- মাহাতাব আকন্দ
বন্ধুগণ
চলুন আজ আমরা — কুরআনের দৃষ্টিতে “জমি বন্ধক” বা “রাহন” বিষয়টির প্রকৃত হুকুম ও মানবিক অর্থ।
এটি কোনো ফিকহি মতের শুষ্ক বিতর্ক নয়; বরং আল্লাহর ন্যায়নীতির সুধায় ভেজা এক অর্থনৈতিক নীতিমালা, যা মানুষের হৃদয়কে সত্য, ন্যায়, এবং বিশ্বস্ততার বন্ধনে বাঁধতে চায়।

বন্ধুগণ,
কুরআনের “রাহন” শব্দটি এসেছে সূরা আল-বাকারা ২৮৩ নম্বর আয়াতে—
وَإِن كُنتُمْ عَلَىٰ سَفَرٍ وَلَمْ تَجِدُوا كَاتِبًا فَرِهَانٌ مَّقْبُوضَةٌ
“আর যদি তোমরা সফরে থাকো এবং কোনো লেখক না পাও, তবে বন্ধক (রাহন) গ্রহণ করা যেতে পারে।”

এ এক অসাধারণ আয়াত—এখানে আল্লাহ মানুষকে লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্ক করছেন, কারণ অর্থের ব্যাপারে অবিশ্বাস, প্রতারণা ও ভুল বোঝাবুঝি মানুষের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে।
আল্লাহ বলছেন, লেখক না পেলে বন্ধক রাখা যেতে পারে—অর্থাৎ, চুক্তি যদি লিখিতভাবে না হয়, তবে নিরাপত্তার জন্য কোনো সম্পদ জামানত রাখা যেতে পারে।

এই আয়াতে “ফারিহানুম মাকবূযাহ” কথাটি গভীর তাৎপর্য বহন করে। “মাকবূযাহ” মানে—“গ্রহণ করা হয়েছে” বা “হাতে নেওয়া হয়েছে”।
অর্থাৎ, শুধু মুখে বন্ধক নয়, চুক্তি বাস্তবভিত্তিক হতে হবে।

বন্ধুগণ,
এই আয়াতে বন্ধকের অনুমতি দেওয়া হলেও, কুরআন এখানে কোনো ব্যবসার সুযোগ দেয়নি।
বন্ধক কেবল একটি বিশ্বাসের দলিল—ঋণের নিরাপত্তার জন্য একটি আমানত।

কিন্তু আজ আমরা দেখছি, সমাজে “বন্ধক” হয়ে গেছে শোষণ ও দখলের হাতিয়ার।
কেউ ঋণ নেয়, তার জমি বন্ধক রাখে—আর সেই জমি চাষ করে বন্ধকগ্রহীতা বছরের পর বছর ফসল নেয়।
এই প্রথা কুরআনের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

কারণ কুরআন সুস্পষ্টভাবে বলে—
وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ
“তোমরা নিজেদের সম্পদ একে অপরের মধ্যে অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।” (সূরা আল-বাকারা ২:১৮৮)

অন্যায়ভাবে ভোগ করা অর্থাৎ, কারও কষ্টার্জিত সম্পদ নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা—এটি হারাম।
সুতরাং জমি বন্ধক রেখে ফসল নেওয়া, ফল খাওয়া, আয় ভোগ করা—সবই “বাতিল ভক্ষণ”-এর অন্তর্ভুক্ত।

বন্ধুগণ,
আল্লাহ লেনদেনের ক্ষেত্রে মূলনীতি দিয়েছেন ন্যায়, স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততার উপর।
তিনি বলেন—
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا تَدَايَنتُم بِدَيْنٍ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى فَاكْتُبُوهُ
“হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ নাও, তখন তা লিখে রাখো।” (সূরা আল-বাকারা ২:২৮২)

এই আয়াত কুরআনের দীর্ঘতম আয়াত। আল্লাহ এখানে মানুষকে শেখাচ্ছেন কীভাবে আর্থিক সততা বজায় রাখতে হয়।
যদি লেখা সম্ভব না হয়, তখনই ২:২৮৩ আয়াতে “রাহন” বা “বন্ধক” এর কথা এসেছে।

অর্থাৎ বন্ধক হলো ব্যতিক্রমী অবস্থা, স্বাভাবিক নিয়ম নয়।
কুরআনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, দাসত্বের জন্য নয়।
কিন্তু আজ আমরা দেখি, বন্ধক হয়ে গেছে দাসত্বের আধুনিক রূপ—
গরীব তার জমি হারায়, ধনী তার পরিশ্রম খেয়ে নেয়।
এ যেন আয়াতের সরাসরি অমান্যতা।

বন্ধুগণ,
যে ব্যক্তি জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়, সে দুর্বল অবস্থায় থাকে।
আর যে বন্ধক নেয়, তার হাতে থাকে ক্ষমতা।
কুরআন এই ক্ষমতাকে শোষণের জন্য ব্যবহার করতে বলে না, বরং এই ক্ষমতা আমানতের সংরক্ষণের জন্য বলেছে।

আল্লাহ বলেন—
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ দেন, আমানতগুলো তাদের অধিকারীদের কাছে ফিরিয়ে দিতে।” (সূরা আন-নিসা ৪:৫৮)

এখানেই বন্ধকের প্রকৃত নৈতিকতা—
জমি বা সম্পদ বন্ধক রাখা মানে হলো অস্থায়ীভাবে আমানত রাখা,
ঋণ পরিশোধের পর তা ফেরত দেওয়া বাধ্যতামূলক।

যে বন্ধকগ্রহীতা জমি দখল করে রাখে, ফেরত দেয় না—সে আসলে আমানতের খিয়ানতকারী।
কুরআন বলে—
إِنَّ اللّهَ لا يُحِبُّ الْخَائِنِينَ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদের ভালোবাসেন না।” (সূরা আল-আনফাল ৮:৫৮)

বন্ধুগণ,
আজ আমরা যে বন্ধক প্রথা দেখি—যেখানে গরীব মানুষ ঋণের বদলে তার জমি হারায়—
এটি কুরআনের রাহন নয়, বরং রিবা (সুদ)-এর আরেকটি রূপ।

আল্লাহ রিবার বিষয়ে বলেন—
وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
“তোমরা যদি মুমিন হও, তবে সুদের অবশিষ্ট অংশ ত্যাগ করো।” (সূরা আল-বাকারা ২:২৭৮)

আরও বলেন—
فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ
“আর যদি তা না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও।” (২:২৭৯)

বন্ধক যদি হয় সুদ, যদি হয় দখলদারিত্ব,
তাহলে তা আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমান—
কারণ এটি দুর্বল মানুষের রক্ত চুষে নেওয়ার পদ্ধতি।

বন্ধুগণ,
কুরআনের অর্থনীতির ভিত্তি হলো মানবিক সহানুভূতি, ন্যায়বিচার ও করুণা।
আল্লাহ বলেন—
وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ
“তোমরা ন্যায়বিচারের সাথে ওজন স্থাপন করো, এবং মানদণ্ডে কম দিও না।” (সূরা আর-রহমান ৫৫:৯)

এই নীতিই বন্ধকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
যখন জমি বন্ধক রাখা হয়, তখন চুক্তিটি হতে হবে ন্যায়ের ভিত্তিতে—
কোনো পক্ষের ক্ষতি যেন না হয়।

কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, দরিদ্র কৃষক জমি হারিয়ে পথে বসে যায়।
তার জমি থেকে অন্যজন ফসল তোলে, অথচ সে ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পায় না।
এটি আল্লাহর দৃষ্টিতে এক ভয়াবহ জুলুম।

কুরআন বলে—
وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
“আল্লাহ জালিমদের ভালোবাসেন না।” (সূরা আলে ইমরান ৩:৫৭)

বন্ধুগণ,
কুরআনের “রাহন” শব্দটি এসেছে “রুহন” মূল থেকে, যার অর্থ বন্ধন বা ধরা পড়া।
এই অর্থেই আল্লাহ বলেন—
كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ
“প্রত্যেক প্রাণ যা অর্জন করেছে, তাতেই সে বন্দী।” (সূরা আল-মুদ্দাসসির ৭৪:৩৮)

এ আয়াত আমাদের শেখায়, “রাহন” মানে কারও পরিশ্রম ও কর্মফলের মধ্যে দায়বদ্ধতা।
অর্থাৎ, কুরআনের দৃষ্টিতে রাহন কেবল বস্তুগত বন্ধন নয়, এটি নৈতিক দায়ও।
যে বন্ধক গ্রহণ করে, সে দায়িত্ব নেয় ন্যায়ের;
যে বন্ধক রাখে, সে দায়িত্ব নেয় বিশ্বস্ততার।
এই দু’য়ের মধ্যে যদি ন্যায়বিচার থাকে, তবে তা কুরআনিক রাহন।
যদি শোষণ থাকে, তবে তা কুরআনবিরোধী লেনদেন।

বন্ধুগণ,
কুরআন শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্কের নীতি দেয়নি; দিয়েছে মানবিক নৈতিকতার ভিত্তি।
লেনদেনকে রিচুয়াল নয়, নৈতিক আমানত হিসেবে দেখিয়েছে।

তাই আল্লাহ বলেন—
فَإِنْ أَمِنَ بَعْضُكُم بَعْضًا فَلْيُؤَدِّ الَّذِي اؤْتُمِنَ أَمَانَتَهُ وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ
“যদি তোমরা একে অপরের প্রতি আস্থা রাখ, তবে যে বিশ্বাসপাত্র সে যেন তার আমানত ফিরিয়ে দেয় এবং তার প্রভুকে ভয় করে।” (সূরা আল-বাকারা ২:২৮৩)

দেখো বন্ধুগণ, আল্লাহ বন্ধক ও ঋণের আলোচনা শেষ করেছেন “ওয়াল ইয়াত্তাকিল্লাহা রব্বাহু”—“তার প্রভুকে ভয় করুক” দিয়ে।
অর্থাৎ, বন্ধক লেনদেন শুধু আইন নয়, তা তাকওয়ার বিষয়।
যে অন্যের সম্পদকে নিজের লাভের মাধ্যম বানায়, সে প্রকৃত মুমিন নয়।

বন্ধুগণ,
যদি সমাজে কুরআনিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে কেউ অন্যের জমি দখল করে বন্ধক রাখবে না।
যে জমি বন্ধক রাখা হবে, তা থাকবে শুধু চুক্তির নিরাপত্তার জন্য,
আর ঋণ শোধ হলেই তা ফিরিয়ে দিতে হবে বিনা শর্তে।

যদি বন্ধকগ্রহীতা সেই জমি ব্যবহার করতে চায়, তবে তা হতে হবে উভয়ের সম্মতিতে,
এবং জমির আয় হিসাব করে ঋণের পরিমাণ থেকে বাদ দিতে হবে।
অন্যথায়, সেটি “অন্যায় ভোগ”—যা কুরআন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।

আল্লাহ বলেন—
تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا
“এগুলো আল্লাহর সীমারেখা, তোমরা তা অতিক্রম করো না।” (সূরা আল-বাকারা ২:২২৯)

বন্ধকের মাধ্যমে যখন মানুষকে জমিহীন করা হয়, তখন সেই সীমারেখা লঙ্ঘিত হয়।
এটি কেবল অর্থনৈতিক অপরাধ নয়, বরং এক নৈতিক বিদ্রোহ আল্লাহর বিরুদ্ধে।

বন্ধুগণ,
কুরআনের সমাজে বন্ধক মানে হবে—
একজন অপরজনের ওপর ভরসা করে দায়িত্ব নেওয়া।
এখানে কোনো শোষণ নেই, আছে পারস্পরিক আস্থা।

যদি মানুষ সত্যিই “وَلْيَتَّقِ اللَّهَ رَبَّهُ” অর্থাৎ “তার প্রভুকে ভয় করে”,
তবে কেউ অন্যের জমি গ্রাস করবে না।
কারণ সে জানবে, পৃথিবীর সব সম্পদ আল্লাহর—
وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
“আসমান ও জমিনের মালিকানা কেবল আল্লাহরই।” (সূরা আল-মায়িদা ৫:১২০)

তাহলে মানুষ কিভাবে অন্যের জমি নিজের বলে দাবী করতে পারে?
বন্ধকের নামে দখলদারিত্ব তো আসলে আল্লাহর মালিকানায় হস্তক্ষেপ!

বন্ধুগণ,
কুরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ আদেশ দেন ন্যায় ও কল্যাণ করতে।” (সূরা আন-নাহল ১৬:৯০)

সুতরাং “জমি বন্ধক” যদি হয় ন্যায়ের ভিত্তিতে, তবে তা বৈধ।
কিন্তু যদি হয় শোষণ, লাভ, সুদ বা দখলের ভিত্তিতে—তবে তা অবৈধ।
কারণ আল্লাহর অর্থনীতি লাভের জন্য নয়, ন্যায়ের জন্য।

বন্ধুগণ,
যখন কুরআন ন্যায়ভিত্তিক সমাজের কথা বলে, তখন বন্ধক প্রথা সেখানে হারিয়ে যায়।
কারণ মানুষ একে অপরের প্রতি এমন আস্থাশীল হয়ে ওঠে যে,
বন্ধক রাখার প্রয়োজনই থাকে না।

আল্লাহ বলেন—
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
“নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই।” (সূরা আল-হুজরাত ৪৯:১০)

ভাই ভাইয়ের সাথে বন্ধক নয়, আমানত হয়।
ভাই ভাইয়ের মধ্যে সুদ নয়, সহানুভূতি হয়।
ভাই ভাইয়ের মাঝে জমি দখল নয়, একে অপরকে সহায়তা হয়।

বন্ধুগণ,
কুরআনের দৃষ্টিতে “জমি বন্ধক” কোনো লেনদেন নয়—এটি এক নৈতিক চুক্তি।
যেখানে ন্যায় আছে, বিশ্বাস আছে, তাকওয়া আছে—
সেখানে রাহন বৈধ।

কিন্তু যেখানে দখল, সুদ, জুলুম, লোভ—
সেখানে বন্ধক নিষিদ্ধ, কারণ তা আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন।

কুরআন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ
“শেষ পরিণতি তাদেরই, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে।” (সূরা আল-কাসাস ২৮:৮৩)

তাই বন্ধুগণ, চলুন আমরা এমন এক সমাজ গড়ি
যেখানে মানুষ একে অপরের সম্পদ নয়, আস্থা বন্ধক রাখবে;
যেখানে জমি নয়, বিশ্বাস হবে নিরাপত্তার প্রতীক;
যেখানে বন্ধক নয়, ন্যায় ও তাকওয়া হবে সব লেনদেনের মূল চুক্তি।

এটাই কুরআনের রাহন—
এক বিশ্বাসের বন্ধন,
যেখানে মানুষ আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলে—
“আমি ন্যায় করবো, কারণ আমার রব ন্যায়প্রেমী।” 

Post a Comment

0 Comments