Subscribe Us

রুকূকারীদের সমাজ — বিনয়ের আহ্বান



রুকূকারীদের সমাজ — বিনয়ের আহ্বান

লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ

১️⃣ বাকারার ৪৩ আয়াত
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ
অর্থ:
"সালাত প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত প্রদান করো, আর রুকূকারীদের সঙ্গে রুকূ করো।"
(সূরা আল-বাকারা ২:৪৩)

২️⃣ আলে ইমরানের ৪৩ আয়াত
يَا مَرْيَمُ اقْنُتِي لِرَبِّكِ وَاسْجُدِي وَارْكَعِي مَعَ الرَّاكِعِينَ
অর্থ:
"হে মরিয়ম! তোমার পালনকর্তার প্রতি আত্মনিবেদন করো, সেজদা করো এবং রুকূকারীদের সঙ্গে রুকূ করো।"
(সূরা আলে ইমরান ৩:৪৩)

বন্ধুগণ,
আল্লাহর এই দুই আয়াত যেন দুই ধ্বনি—
একটি এসেছে পুরো জাতির উদ্দেশ্যে,
আরেকটি এসেছে এক নারীর প্রতি,
কিন্তু বার্তাটি একটাই কথা বোঝায় —
নত হও সত্যের সামনে, আর বিনীতদের দলে যোগ দাও।

বন্ধুগণ,
“রুকূ” কোনো শরীরের ভঙ্গি নয়,
এটা হৃদয়ের অবস্থান।
যখন মানুষ তার অহংকার নামিয়ে রাখে,
নিজেকে বলে — “আমি জানি না, আমাকে শেখাও” —
তখন সে রুকূ করে।

রুকূ মানে কুরআনের ভাষায় —
আল্লাহর বিধানের সামনে বিনীতভাবে মাথা নত করা,
ন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করা,
আর অন্যায়ের মুখে সাহসের সঙ্গে নরম কণ্ঠে “না” বলা।

বন্ধুগণ,
সুরা বাকারার ৪৩ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
ওয়ারকা‘উ মা‘আর রকিইন” — রুকূকারীদের সঙ্গে রুকূ করো।

অর্থাৎ, একা ন্যায়ের পথে থেকো না,
বিনয়ের মানুষদের দলে যোগ দাও।
তাদের পাশে দাঁড়াও, যাদের হৃদয় নম্র,
যারা মানুষের উপরে নয়,
আল্লাহর বিধানের উপরে আস্থা রাখে।

বন্ধুগণ,
এই আহ্বান কেবল ধর্মীয় আচার নয় —
এটা সমাজ গঠনের ভিত্তি।
যেখানে সবাই বলে,
“আমি বড় নই, সত্য বড়।”
যেখানে কেউ কারো উপরে নয়,
সবাই সমান এক ন্যায়ের রাজ্যে।

এই সমাজেই সালাত প্রতিষ্ঠিত হয় —
সালাত মানে শুধু নামাজ নয়,
বরং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার এক ধারা,
যেখানে চিন্তা, আচরণ, নৈতিকতা সবকিছু আল্লাহর পথে বাঁধা।

বন্ধুগণ,
যখন আল্লাহ মরিয়মকে বললেন,
ইয়ামারইয়ামু অকনুতি লি রাব্বিকি, ওয়াসজুদি, ওয়ারকা‘ই মা‘আর রা’কিইন।
তিনি বললেন না, “একাই রুকূ করো।”
বললেন, “রুকূকারীদের সঙ্গে রুকূ করো।”

অর্থাৎ,
আল্লাহ একক ভক্তি চান না,
চান সামষ্টিক বিনয়,
একটি সমাজ, যেখানে সবাই নত হয় আল্লাহর বিধানের কাছে,
কেউ কারো দাস নয়, সবাই এক বিধানের দাস।

বন্ধুগণ,
এটা সেই একই চেতনা যা ইসমাইল (আ.) এর মধ্যে দেখা গিয়েছিল।
যখন তাঁর পিতা বললেন,

“আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে কোরবানি করছি।”
তিনি বলেছিলেন,
“হে পিতা, আপনি যা আদেশ পেয়েছেন, তাই করুন;
আপনি আমাকে, ইনশাআল্লাহ, ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।”

দেখুন, তিনিও রুকূ করেছিলেন,
কিন্তু তা কোনো ঝুঁকে পড়া নয় —
বরং নিজের আত্মাকে আল্লাহর বিধানের হাতে সমর্পণ করা।

বন্ধুগণ,
রুকূকারীরা কখনো মানুষকে প্রভু বানায় না,
তারা আল্লাহকেই একমাত্র বিধানদাতা মানে।
তারা বলে না, “আমার মাজহাব”, “আমার ইমাম”,
তারা বলে —
“আমাদের পথ একটাই — আল্লাহর পথ।”

তাদের চোখে সালাত মানে রিচুয়াল নয়,
এটা এক নৈতিক ঘোষণা —
যে আমি বিনয়ী, আমি ন্যায়পরায়ণ,
আমি কারো দাস নই, আমি আল্লাহর দাস।

বন্ধুগণ,
মরিয়মের রুকূ ছিল নিরব বিনয়,
ইসমাইলের রুকূ ছিল ধৈর্যের শক্তি,
আর বাকারার রুকূ ছিল সামাজিক ঐক্য।
এই তিনটি মিলেই গড়ে ওঠে এক চেতনার জাতি —
যারা সত্যে এক, নত কিন্তু দৃঢ়,
নম্র কিন্তু অবিচল।

বন্ধুগণ,
রুকূকারীরা কখনো লোক দেখানো মানুষ নয়,
তারা গোপনে নিজেকে সংশোধন করে,
ভিতরে ভিতরে মাটি হয়ে যায়,
কারণ তারা জানে —
আল্লাহর কাছে বড় হতে হলে
নিজেকে ছোট করতে হয়।

তাদের সালাত সময়ের মধ্যে বাঁধা নয়,
বরং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ছড়িয়ে আছে।
যেখানে অন্যায় দেখে তারা বলে,
“এটা আল্লাহর বিধান নয়।”
যেখানে অসত্য দেখে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়,
কারণ তারা রুকূকারীদের দলভুক্ত —
সত্যের সঙ্গে নত,
অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্থির।

বন্ধুগণ,
যখন কুরআন বলে “ওয়ারকা‘উ মাআর রা’কিইন”,
এটা শুধু “একসাথে নামাজ পড়ো” নয়,
বরং বলে —
“একসাথে সত্যে নতি স্বীকার করো।”
যখন সমাজে সবাই সত্যের প্রতি বিনয়ী হয়,
তখন অন্যায় টিকে থাকতে পারে না।

বন্ধুগণ,
আজকের মানুষ সালাত জানে, কিন্তু সালাতের চেতনা জানে না।
তারা রুকূ করে দেহে, কিন্তু মন থাকে উঁচুতে।
তারা সেজদা করে, কিন্তু অহংকারে ভরা থাকে।
কুরআন এই ভণ্ডামির দেয়াল ভাঙতে চায়।

রুকূ মানে কুরআনের কাছে ফিরে আসা,
নিজেকে প্রশ্ন করা —
“আমি সত্যের সামনে নত তো?”
“আমি আল্লাহর বিধানের প্রতি বিনয়ী তো?”

বন্ধুগণ,
যদি আমরা রুকূকারীদের সমাজ গড়তে পারি,
তবে অন্যায় বিলীন হবে,
মানুষ হবে বিনয়ী,
এবং সমাজে উঠবে সেই কুরআনিক আলো —
যেখানে সব মন আল্লাহর বিধানে সমানভাবে নতি স্বীকার করে।

এই সমাজেই মরিয়মের সেজদা, ইসমাইলের ধৈর্য,
আর বাকারার রুকূ — এক হয়ে যায়।
এই সমাজেই সালাত হয় জীবন্ত,
যাকাত হয় ভাগাভাগির ন্যায্যতা,
আর রুকূ হয় সত্যের প্রতি বিনয়।

বন্ধুগণ,
তাহলে চলো,
আমরা সেই রুকূকারীদের দলে যোগ দিই —
যারা দেহ নয়, হৃদয়ে নতি জানে,
যারা লোক দেখানো নয়, আত্মসমর্পণ জানে,
যারা মরিয়মের মতো বলে,

আমি তোমার রবের প্রতি আত্মনিবেদন করেছি।”
সারমর্ম:
রুকূ — মানে নয় ঝুঁকে পড়া,
বরং সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করা।
রুকূকারীদের সঙ্গে রুকূ — মানে নয় ভিড়ে মিশে নামাজ পড়া,
বরং সত্যনিষ্ঠ, বিনয়ী, ন্যায়পরায়ণ সমাজে একত্র হওয়া।
এই চেতনা-ই কুরআনের আহ্বান —
যেখানে আল্লাহর বিধানই সর্বোচ্চ,
আর মানুষ কেবল তাঁরই সামনে নত।

Post a Comment

0 Comments