একজন কুরআনিষ্টের দিন কেমন যায়!
লিখকঃ- মাহাতাব আকন্দ
সকাল নামলে পৃথিবী যেমন নতুন হয়ে জেগে ওঠে,
তেমনি একজন কুরআনিষ্ট মানুষও প্রতিদিন নিজেকে নতুন করে জাগায়।
তার কাছে দিন শুরু মানে শুধু সূর্যের আলো নয়,
একটি নতুন চিন্তা, একটি নতুন উপলব্ধি।
সে ঘুম থেকে ওঠে ধীরে, মনে মনে বলে—
আজকের দিনটা আমার জন্য এক পরীক্ষা।
আজও আমি অবশ্যই সত্য, ন্যায়, আর কল্যাণের পথে থাকবো।
সে আয়াত মনে আনে—
“তুমি তোমার প্রভুর নাম স্মরণ করো এবং সম্পূর্ণভাবে তাঁর দিকেই আত্মনিবেদন করো।” (৭৩:৮)
এটিই তার সকালবেলার ধ্যান।
কোনো নির্দিষ্ট রিচুয়াল নয়,
বরং এটি একটি মনের সাথে মনের কথা,
যেখানে সে নিজেকে মনে করায়—
আমি একা নই, আমার সঙ্গে আছেন আল্লাহ,
আমার প্রতিটি কাজের হিসেব তাঁর নিকট আছে।
সে জানে, দিন শুরু মানে শুধু কাজের পরিকল্পনা নয়,
মনকেও প্রস্তুত করা দরকার,
যাতে কোনো লোভ-লালসা, অন্যায় বা অহংকার
তাকে ধরে ফেলতে না পারে।
সকাল: সৎ কাজের সূচনা
সে তার কাজের জায়গায় মনকে শান্ত রাখে।
দুনিয়ার ব্যস্ততা, প্রতিযোগিতা, লোভ—সব সে জানে,
কিন্তু সে তার মনকে নিরবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
সে জানে, আল্লাহ বলেন—
“মানুষ যা চেষ্টা সে তাই পায়।” (৫৩:৩৯)
তাই সে তার কাজকে ইবাদত মনে করে।
সে জানে,
যখন সে সৎভাবে কাজ করে, কারো ক্ষতি করে না,
তখন সে কুরআনের শিক্ষা সালাতেই প্রতিষ্ঠিত আছে।
সে ব্যবসা করলে ওজনে কম দেয় না।
সে কর্মচারী হলে কর্তব্য পালনে অবহেলা করেনা।
শিক্ষক হলে মন দিয়ে শেখায়।
সে জানে— কর্তব্যে অবহেলা মানে সালাতে গাফেল হওয়া।
যে তার কর্তব্যে গাফেল হয় সে আল্লাহর অভিশাপের শিকার হয়।
কুরআন শুধু পড়ার জন্য নয়,
কুরআন হলো আচরণের নির্দেশিকা।
কেউ যখন তার পাশে অন্যায় করে
সে চুপ থাকে না, কিন্তু সে মারামারিও করে না।
সে জানে ন্যায়ের পথ মানে উত্তেজনা নয়, দৃঢ়তা।
সে শান্ত থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে।
সে নিজের মনের কথা শোনে আয়াতের মতো—
“সততা কোনো দান নয়, এটি দায়িত্ব।”
এভাবেই তার সকাল গড়ে ওঠে—
একটি জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে।
দুপুর: আত্মসংযম ও কৃতজ্ঞতা
দিনের মধ্যভাগে সে একটু বিরতি নেয়।
খাবার খাওয়ার সময় সে মনে রাখে—
আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ে সে বিলম্ব করেনা,
সে জানে,
শুধু “আলহামদুলিল্লাহ” বললেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়না। আরো কি কিছু বিধান ফলো করতে হয়-
যেমন - হালাল খাবার গ্রহণ করা,
অপচয় না করা,
নিজের উপার্জনে সন্তুষ্ট থাকা।
সে মনে করে আল্লাহর আয়াত—
(وكُلُوْا وَاشْرَبُوْا وَلَا تُسْرِفُوْا)
“খাও, পান করো, কিন্তু অপচয় করো না।” (৭:৩১)
তার চোখে খাবার মানে বিলাসিতা নয়,
খাবার মানে আল্লাহর দান,
যা তাকে নতুন শক্তি দেয় সৎ পথে থাকতে।
দুপুরে সে নিজের ভেতরে তাকায়।
“আজ সকাল থেকে আমি কেমন আছি?
কোথাও মিথ্যা বলেছি কি?
কারো প্রতি অন্যায় করেছি কি?”
এই প্রশ্নগুলিই তার আত্মপর্যালোচনা।
সে নামাজ পড়ে না ঘড়ির সময় দেখে,
সে সালাত আদায় করে যখন নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারে।
তার সেজদা হয় নিজের অহংকারের ওপর।
তার রুকু হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নম্রতায় দাঁড়ানো।
সে জানে,
নামাজ মানে শারীরিক রীতিনীতি নয়,
নামাজ মানে মনকে সোজা রাখা।
দুপুরের রোদে যখন মানুষ ক্লান্ত হয়,
সে তখনও শান্ত থাকে, কারণ তার হৃদয় ঠান্ডা।
কুরআনের শিক্ষা তাকে ভারসাম্য শেখায়।
বিকেল: মানুষের সঙ্গে আচরণ
বিকেলে সে সমাজের সঙ্গে মেশে।
সে বাজারে যায়, প্রতিবেশীর খোঁজ নেয়,
কাউকে সাহায্য করে, কারো পরামর্শ শোনে।
সে জানে,
“মানুষের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বল।” (২:৮৩)
এই আয়াত তার প্রতিটি কথার ভিত।
সে কণ্ঠ উঁচু করে না,
অন্যের মতামতকে তুচ্ছ করে না।
তার কাছে বড় হওয়া মানে হলো বিনয়ী হওয়া।
সে জানে, মানুষ ভুল করে,
তাই সে দ্রুত বিচার করে না।
কোনো বন্ধু মিথ্যা বললে সে রাগ করে না,
বরং বোঝায়—
“চলো আমরা দুজনেই কুরআনের আলোয় ভাবি।”
সে পরিবারে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়,
শিশুদের শেখায়—
আল্লাহ ভয় পাওয়ার বিষয় নয়,
আল্লাহ ভালোবাসার উৎস।
সে কাউকে নিয়ে গীবত করে না,
কারণ সে জানে গীবত মানে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া। (৪৯:১২)
এই আয়াত তার মনে সবসময় বাজে,
যখন কারো বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে ইচ্ছে হয়।
সন্ধ্যা: আত্মসমালোচনা
দিনের শেষে যখন আকাশে লাল আভা মিশে যায়,
সে ঘরে ফিরে একান্তে বসে।
চারপাশের শব্দ কমে আসে,
তার ভেতর শুরু হয় একটি নীরব সংলাপ।
সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে—
“আজ আমি কেমন দিন কাটালাম?
কোথায় সত্য বলেছি, কোথায় নীরব থেকেছি?
কোথাও কি অন্যের হক নষ্ট করেছি?”
এমন প্রশ্নই তাকে উন্নত করে।
সে জানে, তওবা মানে মুখে বলা নয়,
তওবা মানে মনোভাবের পরিবর্তন।
সে যদি কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকে,
তাহলে আগামীকাল দেখা করে ক্ষমা চাইবে বলে স্থির করে।
সে যদি কারো বিষয়ে ভুল ধারণা পোষণ করে থাকে,
তাহলে নিজের মন পরিষ্কার করে নেয়।
এই আত্মসমালোচনাই তার আসল ইবাদত।
এতে নেই আড়ম্বর,
নেই বাহ্যিক ভক্তি,
আছে নিজের সাথে সততা।
সে আয়াত মনে করে—
Al-Hashr ৫৯:১৮
وَلۡتَنظُرۡ نَفۡسࣱ مَّا قَدَّمَتۡ لِغَدࣲۖ
আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের জন্য কি প্রেরণ করেছে। (৫৯:১৮)
এই আয়াত তার মনে রাখার বই।
প্রতিদিনের শেষে সে এই আয়াতকে সামনে রাখে,
এবং নিজেকে বিচার করে।
রাত: চিন্তা ও জ্ঞান
রাত নামলে, মানুষ বিশ্রামে যায়,
কিন্তু একজন কুরআনিষ্ট কিছু সময় রাখে চিন্তার জন্য।
সে বই পড়ে, কুরআনের আয়াত নিয়ে ভাবে,
জীবনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে।
সে জানে,
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ أَمۡ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقۡفَالُهَآ
তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা- ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে? (৪৭:২৪)
এই আয়াত তার চিন্তার দিগন্ত খুলে দেয়।
সে ভাবে, কুরআন শুধু পড়ার বিষয় নয়,
কুরআন হলো ভাবার বিষয়।
সে আয়াতের মানে নিজের জীবনে খুঁজে নেয়।
যেমন—
যখন কুরআন বলে “ন্যায় করো”,
সে দেখে তার অফিসে বা পরিবারে
সে কি আসলেই ন্যায্য আচরণ করছে?
যখন কুরআন বলে “অন্যের হক আদায় করো”,
সে ভাবে— আমি কি কারো পাওনা আটকে রেখেছি?
এইভাবে চিন্তা করতে করতে
সে নিজের ভুল ও সীমাবদ্ধতাকে চিনে ফেলে,
আর পরদিন আরও ভালো মানুষ হওয়ার ইচ্ছা জাগে।
রাতের নীরবতা তার জন্য স্কুলের মতো,
যেখানে সে নিজেকে শেখে।
সে জানে,
“রাতের কিছু অংশে চিন্তা-মননে নিযুক্ত থাকো।” (১৭:৭৯)
এই আয়াত তার রাতের শান্ত সঙ্গী।
সারাদিনের মূল ভাবনা
একজন কুরআনিষ্টের পুরো দিনের মূলভিত্তি হলো—
সচেতনতা, ন্যায়, দয়া, ও আত্মসংযম।
সে সকাল শুরু করে কৃতজ্ঞতায়,
দুপুরে কাটায় সততায়,
বিকেলে মেলে মানবতায়,
রাতে ফিরে যায় চিন্তায়।
তার কাছে ঈমান মানে কোনো বিশেষ পোশাক নয়,
তার কাছে ঈমান মানে সৎ থাকা।
তার কাছে ইবাদত মানে নির্দিষ্ট ভঙ্গি নয়,
ইবাদত মানে আল্লাহর আদর্শে জীবনযাপন।
সে আল্লাহকে ভয় পায় না আতঙ্কে,
বরং ভালোবাসে সচেতনভাবে।
সে জানে—
আল্লাহ বলেছেন- নাহনু আকরবু মিন হাবলিল ওয়ারিদ,
“আমি তার গলার শিরার চেয়েও নিকটবর্তী।” (৫০:১৬)
তাই তার আল্লাহ দূরের নয়,
তার আল্লাহ কাছের,
তার আল্লাহ তার চিন্তায়, তার কাজের ভেতর।
জীবনের রূপ
সে কারো থেকে বড় হতে চায় না,
সে শুধু ভালো হতে চায়।
সে বোঝে, কুরআন তাকে শ্রেষ্ঠ বানানোর নয়,
বরং সঠিক বানানোর জন্য এসেছে।
সে কারো ধর্ম দেখে বিচার করে না,
সে দেখে মানুষ কেমন আচরণ করছে।
কারণ কুরআন বলেছে—
“সবচেয়ে সম্মানিত সে, যে সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ।” (৪৯:১৩)
এই আয়াত তার হৃদয়ে প্রতিদিন জ্বলে,
কিন্তু শান্তভাবে, কোনো উত্তাপে নয়।
সে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে শেখে—
গাছ যেমন ফল দেয় কিন্তু কথা বলে না,
তেমনি আমিও আমার আচরণে কুরআনকে প্রকাশ করবো।
সে বুঝে যায়,
কুরআন শেখার মানে মুখস্থ করা নয়,
কুরআন শেখার মানে তার ভাব জীবনে আনা।
দিনশেষের প্রতিজ্ঞা
রাত যখন গভীর হয়,
সে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মনে মনে বলে—
আজ হয়তো আমি সম্পূর্ণ নই,
কিন্তু আমি সচেতন থাকার চেষ্টা করেছি।
আজ আমি মিথ্যার অংশ হইনি,
আজ আমি কারো ক্ষতি করিনি,
আজ আমি কুরআনের পথে একটু হলেও এগিয়েছি।
এই অনুভূতিই তার প্রশান্তি।
তার আর কোনো আনুষ্ঠানিক দোয়া লাগে না,
কারণ তার প্রতিটি সৎ চিন্তাই দোয়া।
সে জানে—
আল্লাহ তার হৃদয়ের ভাবও শুনতে পান।
তার ঘুম হয় শান্তিতে,
কিন্তু সেই শান্তি নিস্তেজ নয়,
বরং আগামী দিনের জন্য নতুন শক্তি।
সে মনে করে—
কুরআনের মানুষ কখনো থেমে থাকে না,
সে প্রতিদিন একটু করে বেড়ে ওঠে,
অন্ধকারের ভেতর থেকেও আলো খুঁজে নেয়।
একজন কুরআনিষ্টের জীবন খুব সাধারণ দেখতে।
সে আলাদা পোশাক পরে না,
আলাদা চিহ্ন বহন করে না,
কিন্তু তার মন আলাদা।
সে প্রতিটি কাজের আগে ভাবে—
এটা ন্যায়ের পথ কি না।
সে প্রতিটি কথার আগে ভাবে—
এতে কারো ক্ষতি হবে কি না।
তার ঈমান প্রকাশ পায় তার আচরণে।
তার ভালোবাসা প্রকাশ পায় তার ন্যায্যতায়।
সে কাউকে ছোট করে না,
কারণ কুরআন শিখিয়েছে—
মানুষ সমান, কেবল চরিত্রে পার্থক্য।
তার দিন যেন নদীর মতো—
শুরু হয় শান্ত জলে,
মাঝে প্রবাহিত হয় কাজে,
শেষে মিশে যায় প্রশান্তির সাগরে।
সে জানে,
মানুষের প্রকৃত পরিবর্তন আসে ভেতর থেকে,
আর সেই পরিবর্তনের আলো আসে কুরআন থেকে।
উপসংহার
একজন কুরআনিষ্টের দিন এভাবেই কাটে—
শান্ত অথচ সচেতন,
নরম অথচ দৃঢ়,
সহজ অথচ গভীর।
সে নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে অনুভব করে,
এবং মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধে পূর্ণ থাকে।
তার সকাল জাগে কৃতজ্ঞতায়,
তার দুপুর চলে সততায়,
তার বিকেল মিশে যায় মানবতায়,
তার রাত ভরে ওঠে চিন্তায় ও শান্তিতে।
সে প্রতিদিন নতুনভাবে শেখে—
কুরআন কেবল পাঠের বই নয়,
এটি জীবনের নির্দেশিকা।
সে জানে—
আল্লাহর সন্তুষ্টি কোনো অনুষ্ঠান দিয়ে নয়,
সৎ, ন্যায়বান ও দয়ালু মানুষ হওয়ার মধ্য দিয়েই আসে।
আর এইভাবেই প্রতিদিনের সাধারণ জীবন
ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে এক কুরআনিক জীবন।
🌸 – সমাপ্ত –
একজন কুরআনিষ্টের দিন: শান্তি ও ন্যায়বোধের পথে চলা এক মানুষের প্রতিচ্ছবি।

0 Comments